রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভারত-মালদ্বীপের সম্পর্কের সমীকরণ কি বদলাচ্ছে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০:৪২ পিএম

শেয়ার করুন:

ভারত-মালদ্বীপের সম্পর্কের সমীকরণ কি বদলাচ্ছে?

অতীতকে সরিয়ে রেখে আপাতত দ্বিপাক্ষিক অংশীদ্বারিত্বের' ওপরেই জোর দিতে চায় দিল্লি আর মালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুইজ্জু্জুর বিবৃতিতে সেই প্রতিফলনই মিলেছে।

মোদির মালদ্বীপ সফরকালে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান গবেষণার মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূচনা হয়েছে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাও।


বিজ্ঞাপন


যৌথ বিবৃতির সময় দুই দেশকে একে অপরের 'বিশ্বস্ত অংশীদার' হিসেবে উল্লেখ করে ‘গভীর সম্পর্কের’ কথা বলতে শোনা গেছে দুই রাষ্ট্রনেতাকেই।

মোদি বলেছেন, ‘ভারত, মালদ্বীপের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের নেইবার ফার্স্ট নীতি এবং মহাসাগর নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দুই বিষয়েই মালদ্বীপের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। মালদ্বীপের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভারত গর্ব বোধ করে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক বা মহামারী, ভারত সবসময়ই মালদ্বীপের পাশে ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে থেকেছে।’

অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বলেছেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে মালদ্বীপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত অংশীদার। আমাদের সহযোগিতা নিরাপত্তা ও বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং বাইরেও বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিস্তৃত, যা আমাদের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করে।’

প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতিকে সামনে রেখে ক্ষমতায় এসেছিলেন মুইজ্জু। তার শাসনকালে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েন দেখা গিয়েছে যার আঁচ পরেছিল দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও। ক্ষমতায় আসার পরেই মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। বিষয়টাকে ভালো চোখে দেখেনি দিল্লি। তবে মালদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো এবং দুই দেশের মধ্যে একাধিক বিষয়ে অংশীদারত্বের ঘোষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে–– ‘পরিস্থিতি বদলেছে’।


বিজ্ঞাপন


প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় দুই দেশই। ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চারটে সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ এবং তিনটে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

মালদ্বীপকে ভারতীয় মূল্যে চার হাজার ৮৫০ কোটি টাকার লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) সম্প্রসারণ করার কথা ঘোষণা হয়েছে।

মুইজ্জু বলেছেন, ‘ওই এলওসি প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং হাউজিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবহার করা হবে। ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাতও হয়েছে। পাশাপাশি, ভারত সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এলওসি-র ক্ষেত্রে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা হ্রাস করা হয়েছে।

ভারত-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (আইএমএফটিএ) আলোচনার সূচনা হয়েছে। মালদ্বীপকে ৭২টা হেভি ভেহিকেল ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে, মালেতে প্রতিরক্ষা ভবন এবং অবকাঠামোগত স্থাপনার উদ্বোধনও করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

সম্পর্কের টানাপোড়েন

দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘ ৬০ বছরের। এই সময়কালে বিভিন্ন সময় ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কে মোটের ওপর বন্ধুত্বপূর্ণই থেকেছে।

মুইজ্জু অন্য পথে হাঁটলেও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টরা ক্ষমতায় এসে প্রথম ভারত সফর করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহ 'ইন্ডিয়া ফার্স্ট' নীতিই মেনে এসেছিলেন। একই মনোভাব দেখা গেছে অতীতেও।

নরেন্দ্র মোদির সফর নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট সোলিহ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর এটাই দর্শায় যে রাজনৈতিক উসকানি সত্ত্বেও ভারতের মধ্যে এমন একজন বন্ধুকে মালদ্বীপ পেয়েছে যে বিশ্বস্ত এবং সময় তার প্রমাণ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দুই দেশের সম্পর্কে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

তবে ইব্রাহিম সোলিহর পূর্বসূরি আবদুল্লা ইয়ামিন ভারতের বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। সেই পথই অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছিল মুইজ্জুকে।

ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছিল। ওই লেনদেন ২০২২ সালে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়ায় এবং ২০২৩ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভারত মূলত মালদ্বীপে ফার্মাসিউটিক্যালস, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, সিমেন্ট, কৃষি পণ্য এবং নির্মাণ সামগ্রী রফতানি করে। মালদ্বীপ থেকে স্ক্র্যাপ ধাতু আমদানি করে ভারত। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পর্যটক সে দেশে ভ্রমণে যান। কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয় প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর।

দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সুর কাটতে শুরু করেছিল তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় থেকেই। 'ইন্ডিয়া আউট' নীতির প্রচার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোহামেদ মুইজ্জু।

তারপর গত বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদির লাক্ষাদ্বীপ সফরের ছবিতে মালদ্বীপের মন্ত্রী মরিয়াম শিউনা এবং অন্যান্য নেতাদের আপত্তিজনক মন্তব্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক।

ভারতে ট্রেন্ড করতে থাকে ‘বয়কট মালদ্বীপ’–– যার জেরে ভারত থেকে সে দেশে আগত পর্যটকের ঢলেও প্রভাব পড়ে। পর্যটকদের একটা বড় অংশ মালদ্বীপের পরিবর্তে অন্য জায়গাকে পর্যটনের জন্য বেছে নেন।

তবে সমীকরণে পরিবর্তন দেখা যেতে শুরু করে। গত বছর প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভারত সফরে আসেন। সেই সময় ভারতের তরফেও সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। সেই সময় বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অনুমান করেছিলেন সম্পর্কের বরফ গলছে।

অবস্থান পরিবর্তনের কারণ হিসেবে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বিশেষত দেশের আশানুরূপ উন্নয়ন না হওয়ার ফলে মুইজ্জু সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়ার বিষয়গুলো রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। একইসঙ্গে এই দ্বীপরাষ্ট্রকে দেশকে ভারতেরও প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।

‘মৌসুম যেমনই হোক, বন্ধুত্ব থাকবে’

ভারত-মালদ্বীপের অংশীদারিত্বের ওপর জোর দিয়েছেন দুই রাষ্ট্রনেতাই।

মোদি বলেছেন, ‘মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার উন্নয়নে ভারত সমর্থন অব্যাহত রাখবে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি লাভ আমাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য। কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের মাধ্যমে আমরা একসঙ্গে আঞ্চলিক সামুদ্রিক নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করে তুলব। প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা পারস্পরিক আস্থার প্রতিফলন।’

তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিস্থিতি যাই হোক, সম্পর্ক অটুট থাকবে। তার কথায়, ‘আবহাওয়া বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমাদের সহযোগিতা প্রসারিত হবে। আবহাওয়া যাই হোক না কেন, আমাদের বন্ধুত্ব সবসময় উজ্জ্বল এবং পরিষ্কার থাকবে!’

একই সুর শোনা গিয়েছে মুইজ্জুর কণ্ঠেও। তিনি বলেছেন, ‘মালদ্বীপ সরকার একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে, তরুণদের ক্ষমতায়ন এবং এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে ভারত সহায়কের ভূমিকা পালন করে।’

বিশেষজ্ঞরা যেভাবে দেখছেন

‘রাজনীতিতে কিছুই স্থায়ী হয় না। কেউ স্থায়ী মিত্র হয় না, আবার স্থায়ী শত্রুও হয় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য,’ ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কের সাম্প্রতিকতম সমীকরণকে এইভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমার আঘা।

তিনি বলেছেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক শতাব্দী প্রাচীন। কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে গিয়েও দুই দেশের সম্পর্কের ভিত লুকিয়ে আছে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে বিপর্যয় মোকাবিলা-সমস্ত ক্ষেত্রেই মালদ্বীপের পাশে থেকেছে ভারত। কিন্তু সম্পর্কে পরিবর্তনের একটা বড় কারণ চীন। তাদের প্রাধান্য দিতে ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছে মালদ্বীপ।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএইচআর

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর