গাজায় গণহত্যা চালাতে ইসরায়েলকে সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছেন ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূখণ্ডে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ।
‘দখলদারিত্বের অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতি’ র্শীষক প্রতিবেদনটি আগামীকাল বৃহস্পতিবার (০২ জুলাই) জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
বিজ্ঞাপন
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, ফ্রান্সেসকা তার প্রতিবেদনে ৪৮টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট, গুগলের মূল কোম্পানি আলফাবেট এবং ই-কর্মাস জায়ান্ট অ্যামাজন। এছাড়া তদন্তের অংশ হিসাবে আরও ১ হাজারেরও বেশি কোম্পনির একটি ডাটাবেসও তৈরি করা হয়েছে।
এই কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র এখন আর ফিলিস্তিনে দখলদারিত্বেই জড়িত না, এগুলো গাজায় গণহত্যাতে জড়িয়ে পড়েছে। এসব কোম্পানি সহযোগিতা করছে বলেই ইসরায়েল এখনো গণহত্যা চালিয়ে যেতে পারছে এবং এতে তারা ব্যাপক লাভবানও হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটার ফ্রান্সেসকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সামরিক খাতে ইসরায়েলকে সহায়তায় মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা লকহিড মার্টিন গাজায় বোমা হামলায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এফ-৩৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছিল। অন্যদিকে ইসরায়েলকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে ইতালির অস্ত্র কোম্পানি লিওনার্দো এসপিএ। এছাড়া ইসরায়েলে অস্ত্র উৎপাদনের জন্য জাপানের ফ্যানুক কর্পোরেশন রোবোটিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে।
বিজ্ঞাপন
প্রযুক্তি খাতে মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট (গুগলের মূল কোম্পানি), অ্যামাজন, এবং আইবিএম-এর মতো প্রযুক্তি জায়ান্টরা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে নজরদারি এবং বায়োমেট্রিক ডেটা ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করছে।
এরমধ্যে মাইক্রোসফ্ট, অ্যালফাবেট এবং অ্যামাজন ইসরায়েলকে তার নজরদারি ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাদের ক্লাউড এবং এআই প্রযুক্তির অ্যাক্সেস প্রদান করেছে। আর সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ইসরায়েলের জনসংখ্যা, অভিবাসন ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের (পিআইবিএ) কেন্দ্রীয় ডাটাবেস পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে আইবিএম। এটি ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্যও সংরক্ষণ করে। এছাড়া প্যালান্টির টেকনোলজিস ‘ল্যাভেন্ডার’, ‘গসপেল’ এবং ‘ওয়্যার’স ড্যাডি’ এর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসে ইসরায়েলকে সক্ষম করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যন্ত্রপাতি কোম্পানিগুলোর ভূমিকাও তুলে ধরা হয়েছে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কিন যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক ক্যাটারপিলার ইসরায়েলকে বিশেষ বুলডোজার সরবরাহ করেছে, যা বাড়িঘর, হাসপাতাল, মসজিদসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ধ্বংস করতে এবং এমনকি আহত ফিলিস্তিনিদের জীবন্ত কবর দেওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২৫ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ক্যাটারপিলার।
অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার এইচডি হুন্ডাই এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডুসান, সুইডেনের ভলভো গ্রুপও এই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর এবং কৃষিজমি ধ্বংস করার জন্য তাদের সরঞ্জাম ব্যবহার করছে ইসরায়েল।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে রাফাহ এবং জাবালিয়ার মতো এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হুন্ডাই এবং ভলভো যন্ত্রপাতি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এগুলোর লোগো ঢেকে দিয়েছিল।
এদিকে বিশ্বের বৃহত্তম অনলাইন ভ্রমণ সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম বুকিং.কম এবং এয়ারবিএনবি দখলকৃত পশ্চিম তীরের অবৈধ বসতিতে হোটেল এবং সম্পত্তি তালিকাভুাকবতর মাধ্যম আরও অবৈধ বসতি স্থাপনে সহায়তা করছে।
প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রামন্ড কোম্পানি এবং সুইজারল্যান্ডের গ্লেনকোরকে ইসরায়েলের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মূলত কলম্বিয়া থেকে আসে।
কৃষিক্ষেত্রে- চীনের ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড ইসরায়েলের বৃহত্তম খাদ্য সংস্থা তনুভার বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক, যা ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে অবৈধভাবে দখল করা জমিতে চাষাবাদ করে। অন্যদিকে মেক্সিকোর অরবিয়া অ্যাডভান্স কর্পোরেশনের ৮০ শতাংশ মালিকানাধীন ইসরায়েলি কোম্পানি নেটাফিম অধিকৃত পশ্চিম তীরে অবিশ্বাস্য মূল্যে পানি সরবরাহ করে।
এদিকে মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ কোম্পানি ব্ল্যাকরক এবং ভ্যানগার্ডকে বেশ কয়েকটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমে মানবাধিকার লঙ্ঘন এড়াতে বাধ্য। এই ধরনের কার্যকলাপের জন্য কোম্পানি এবং তাদের কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন।
প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের সঙ্গে এমন সব কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অবৈধ।
-এমএইচআর