দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কের কার্যকারিতা দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নের মুখে। প্রায় এক দশক ধরে নিষ্ক্রিয় এই সংস্থার জায়গায় নতুন আঞ্চলিক উদ্যোগের সম্ভাবনা বহুবার আলোচিত হয়েছে। এবার সেই সম্ভাবনাই রূপ নিচ্ছে বাস্তবে—চীন ও পাকিস্তানের নেতৃত্বে গঠিতব্য নতুন আঞ্চলিক জোটে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশও। এই তিন দেশের সমন্বয়ে গঠিত হতে যাওয়া জোটটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি সার্কের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে?
দীর্ঘদিন ধরেই সার্ক কার্যত অচল। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও ২০১৬ সালে ভারতের উরি সেনা ঘাঁটিতে হামলার পর ইসলামাবাদে নির্ধারিত শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। এরপর থেকে রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে আর কোনো সম্মেলন আয়োজিত হয়নি। ভারতের চাপে পাকিস্তানকে একঘরে করার চেষ্টা এবং অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মৌন সমর্থনে জোটটি কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
বিজ্ঞাপন
সার্কের আট সদস্য—আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা—যদিও আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে জোটবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু ভারতের একচেটিয়া নেতৃত্ব এবং প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ জোটের ভেতরে আস্থার সংকট তৈরি করে। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা একাধিকবার সার্কের কার্যক্রম স্থবির করে দিয়েছে।
অন্যদিকে ভারতের ভূমিকাকে ঘিরে ক্ষোভ বাড়ছিল ছোট দেশগুলোর মধ্যে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ—এই তিনটি দেশ সম্প্রতি ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, আঞ্চলিক সহযোগিতার নামে ভারত শুধু নিজের স্বার্থে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে চীন তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকল্প জোটের উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তান আগেই চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র; এখন বাংলাদেশকেও যুক্ত করে নতুন একটি আঞ্চলিক কাঠামো গঠনের ঘোষণা দিয়েছে দুই দেশ। জোটটির আনুষ্ঠানিক নাম এখনও নির্ধারিত হয়নি, তবে নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশের নতুন এই জোটের লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক সংযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাণিজ্য সহায়তা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তায় সহযোগিতা। ইতোমধ্যেই চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ (BRI) আওতায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বড় ধরনের বিনিয়োগ চলছে। নতুন জোট সেই সহযোগিতাকে আরও কাঠামোবদ্ধ করতে পারে।
তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, কেবল অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব দিয়ে কি সার্কের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব পূরণ করা সম্ভব? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্কের শক্তি ছিল তার আঞ্চলিক পরিচয় ও অভিন্ন ইতিহাসের বন্ধন। নতুন জোটে সেই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সংহতির উপাদান অনুপস্থিত।
তবে দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি পূরণের সুযোগও এই জোট তৈরি করছে বলে মনে করেন কূটনৈতিক মহল। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা দেশগুলোও এখন বিকল্প জোটে যুক্ত হতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সঙ্গেও আলোচনার সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে চীনা কূটনৈতিক সূত্রে।
বাংলাদেশের এই জোটে অংশগ্রহণকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা গ্রহণ—এই ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ। কেননা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিগড়ে গেলে তা আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল করতে পারে।
চীনের নেতৃত্বে গঠিতব্য এই নতুন জোট আপাতত সার্কের ‘বিকল্প’ না হলেও, এটি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি নতুন বলয় তৈরি করছে। জোটের কার্যকারিতা নির্ভর করবে তার বাস্তব কর্মপরিকল্পনা এবং সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক আস্থার ওপর।
এইউ