‘জয়ের পিছনে এলাকার ভূগোলেরও একটা অবদান থাকে’। প্রুশিয়ার সেনা অফিসার কার্ল ফন ক্লাউজাউইট্জ (১৭৮০-১৮৩১) এই কথাটা সেই কবেই লিখে গিয়েছিলেন তার 'অন ওয়ার' বা 'যুদ্ধ নিয়ে' তার বইতে। আর ওই কথাগুলো একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে ইরানের সেনাবাহিনী।
ক্লাউজাউইট্জ লিখেছিলেন, যে এলাকায় যুদ্ধ হচ্ছে, সেখানকার নদী, জঙ্গল, পর্বত আর অন্যান্য ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যগুলো শুধু যে "শত্রুর এগিয়ে আসা"য় বাধা দেয়, তা নয়। ওইসব ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যগুলো সবার "নজর এড়িয়ে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ারও সুযোগ" করে দেয়।
বিজ্ঞাপন
ইরানের সেনাবাহিনী সেই কথা মেনেই দেশের মাঝে থাকা খাড়া পাহাড়গুলো ব্যবহার করে সেগুলোর নিচ দিয়ে একাধিক সুড়ঙ্গের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। নানা আকার আর ক্ষমতার ক্ষেপণাস্ত্র মজুত করে রাখা হয় ওই সব সুড়ঙ্গে।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি আটকাতে যখন ইসরায়েল ইরানের ওপরে বোমা হামলা শুরু করল, তার বেশ কয়েক মাস আগেই এরকমই একটি নতুন 'মিসাইল সিটি'র কথা জানিয়েছিলেন ইরানের সামরিক নেতৃত্ব।
শুধুই অস্ত্র মজুতের ভাণ্ডার নয়
অনেক দশক ধরে রকেট মজুত করার যে ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিগুলো তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোকে 'মিসাইল সিটি' নাম দিয়েছে ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)।
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘ আর গভীর সুড়ঙ্গগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। সারা দেশেই মাটির নিচে ছড়িয়ে আছে এইসব ঘাঁটিগুলো। ব্যালিস্টিক আর ক্রুজ মিসাইল সহ অন্যান্য কৌশলগত অস্ত্র, যেমন ড্রোন আর বিমানপ্রতিরোধী ব্যবস্থাপনা এই সব মিসাইল সিটির গভীরে মজুত করা হয়, যাতে প্রয়োজন মতো সেগুলো ছোঁড়া যায়।
ফেব্রুয়ারি মাসে আইআরজিসি-র জারি করা একটি 'টাইম ল্যাপ্স' ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল প্রায় এক ডজন ট্রাক সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকগুলোর ট্রেলারে চাপানো রয়েছে রকেট লঞ্চার। এর পরের দৃশ্যপট বদলে যায়। দেখানো হয় একটি সমুদ্রতীর। সেখানে দাঁড়ানো একটি ট্রাক থেকে একটা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হল সমুদ্রে – এমনটাই ছিল পরবর্তী ছবি।

বিবিসির ফার্সি বিভাগের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইরানের সামরিক কমান্ডাররা স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন, 'মিসাইল সিটিগুলো’ শুধুই রকেট মজুত রাখার স্থাপনা নয়। এগুলোর কয়েকটিতে রকেট উৎপাদনও করা হয়। তবে এইসব মিসাইল সিটি ঠিক কোথায় অবস্থিত, আর কতগুলোই বা এ ধরনের ভূগর্ভস্থ ঘাঁটি আছে, সেই সংখ্যা জানা যায় না। আইআরজিসির বিমান বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ্ সাম্প্রতিকতম মিসাইল সিটির তথ্য দেওয়ার সময়ে নিশ্চিত করেছিলেন, এরকম 'বহু' স্থাপনা আছে।
চোখের আড়ালে অস্ত্র মজুত
ইরানের সামরিক কর্মকর্তারা এই সব ভূগর্ভস্থ 'মিসাইল সিটি’গুলো তৈরিই করেছেন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সম্ভাব্য হামলা থেকে রক্ষা করতে– ঠিক যেরকম হামলা গত ১৩ জুন থেকে চালাচ্ছে ইসরায়েল।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক 'ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডিফেন্স অফ ডেমক্র্যাসি'র ইরান বিভাগের পরিচালক বেহনাম বেন তেলেব্লু বিবিসি ওয়ার্ল্ড টিভিকে বলছিলেন, ‘উপগ্রহের নজর এড়িয়ে যাতে ক্ষেপণাস্ত্র মজুত করা আর নিক্ষেপ করা যায়, সেজন্যই ইরান এই স্থাপনাগুলো বানিয়েছে।’

জেনারেল হাজিজাদেহ্ সাম্প্রতিকতম 'মিসাইল সিটি'র যে ভিডিওটি উপস্থাপন করেছিলেন, সেখানেই স্পষ্ট করে তিনি বলেছিলেন, ওই ঘাঁটিটি মাটির ৫০০ মিটার গভীরে নির্মিত হয়েছে আর তার ওপরে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্তরের কংক্রিটের ঢালাই করা ছাদ।
সাবেক ইউএস মেরিন ও লন্ডন-ভিত্তিক বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা গ্রে ডাইনামিকস-এর বিশ্লেষক মাইকেল এলমার ২০২১ সালে প্রকাশিত তার এক লেখায় জানিয়েছিলেন, ইরানের ওই দাবিগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে থাকা সবথেকে শক্তিশালী বোমা ফেলেও ওই ইরানি ঘাঁটি ধ্বংস করতে বেগ পেতে হবে।
তার ব্যাখ্যা, ‘তবে রকেট উৎক্ষেপণের জন্য পাহাড় ফুটো করে ইরানিরা যে ‘লঞ্চিং বে’ বানিয়েছে, মার্কিনীরা যদি সেখানেও বোমা ফেলতে পারে, তাহলেই ওই ঘাঁটিগুলো অকেজো হয়ে পড়বে।’
তবে বেন তেলেব্লু বলছেন, ওই ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মূল সমস্যা হবে সেগুলো আগে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এখনো পর্যন্ত এটা অজানা যে ওই ঘাঁটিগুলো কোথায় রয়েছে।
মার্কিন থিংক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বা সিএসআইএসের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পের গবেষক প্যাট্রিশিয়া ব্যাজিল্জিকও একই মত পোষণ করেন। তার কথায়, ‘ভূগর্ভস্থ লক্ষ্যবস্তুগুলো কঠিন, তবে সেগুলোতে আক্রমণ চালানো যাবে না এমনটা নয়।’
তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের শক্তিশালী বোমারু জেট বিমান যদি এই ‘মিসাইল সিটি’গুলোতে যদি হামলা চালাতে পারে, তাহলে ইরানের মজুত অস্ত্রভাণ্ডারে আরও আঘাত করা হবে।’

তবে ইরান যে শুধুই তার ক্ষেপণাস্ত্র মজুত ভাণ্ডার মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছে, তা নয়। তাদের কিছু যুদ্ধ বিমান, এমনকি কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজও তারা ভূগর্ভস্থ জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে।
সব ধরনের অস্ত্রই মজুত
এইসব ভূগর্ভস্থ স্থাপনার যে ছবিগুলো তেহরান প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে খাইবার শেকান, হজ কাসেম, এমাদ, সেজ্জিল, কদর-এইচ আর পাভেহ্ ক্রুজ মিসাইলের ছবি দেখা গেছে।
ইরান দাবি করে, এইসব রকেট দিয়ে তারা দুই হাজার কিলোমিটার দূরের দেশেও হামলা চালাতে সক্ষম। অর্থাৎ এই রকেটগুলো ইসরায়েল, সৌদি আরব, ভারত, রাশিয়া আর চিনে হামলা চালাতে পারবে।

ইরান যখন ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের ওপরে হামলা চালিয়েছিল, তখন এমাদ ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছিল। ইসরায়েলের মধ্যভাগে অবস্থিত নাভাতিম বিমান ঘাঁটি ওই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সাম্প্রতিক হামলায় সেজ্জিল মিসাইলও ছুঁড়েছে ইরান, কিন্তু সেগুলো ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পেরেছে বলে জানিয়েছে ইউএস ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার বা আইএসডব্লিউ।
ইরানি অস্ত্র বিজ্ঞানীরা নব্বইয়ের দশকে ১৮ মিটার লম্বা, দুই ধাপ বিশিষ্ট সেজ্জিল ব্যালিস্টিক মিসাইলটি তৈরি করেছিলেন। এটি দুই হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকেও নিশানা করতে পারে। এখন সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার দেখে একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে যে সম্ভবত ইসরায়েলি আক্রমণ সামলাতে সমস্যা হচ্ছে বলেই দেশের অনেকটা অভ্যন্তর থেকে ইরানকে মিসাইল হামলা চালাতে হচ্ছে।
পারমাণবিক অস্ত্রও কি আছে?
থিংক ট্যাঙ্ক সিএসআইএস বলছে, সেজ্জিলসহ ইরানের অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক অস্ত্র বহন করার ক্ষমতা রাখে, তবে বর্তমানে ওইসব ক্ষেপণাস্ত্রগুলোতে পারম্পরিক বিস্ফোরকই ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এখানে একটি প্রশ্ন উঠে আসে: এই 'মিসাইল সিটি'গুলোর সঙ্গে কি ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্পের কোনো সংযোগ আছে?
বিবিসি যতজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা অবশ্য বলছেন যে এরকম কোনও প্রমাণ তারা পান নি।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক সিদ্ধার্থ কৌশল বলছেন, ‘কার্মেনশাহের মতো ইরানের প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির সঙ্গে তাদের পারমাণবিক পরিকল্পনার সরাসরি কোরো যোগাযোগ নেই। ‘ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়েই থাকে তাহলে সাহাব-৩ বা কার্মেনশাহই পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের জন্য আদর্শ জায়গা’, ব্যাখ্যা করছিলেন সিদ্ধার্থ কৌশল।

বেন তেলেব্লুর কথায়, "ইরান যদি তাদের পারমাণবিক প্রকল্পকে অস্ত্রে রূপান্তরিত করতে চায়, তাহলে তাদের হাতে কিন্তু ইতোমধ্যেই সে ধরনের রকেট আছে।"
'মিসাইল সিটি' ইসরায়েলের জন্য বড় ঝুঁকি
মার্কিন গোয়েন্দাদের হিসাব মতো নানা সীমানার, নানা মাপের প্রায় তিন হাজার ক্ষেপণাস্ত্র আছে ইরানের কাছে। আইএসডব্লিউ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এইসব ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারের একটা বড় অংশই ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিগুলোতেই রাখা আছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অবশ্য মনে করে, তেহরানের কাছে হাজার দুয়েক রকেট আছে। তারা এটাও বলছে যে ১৩ জুন থেকে এখনও পর্যন্ত ইরান প্রায় ৩৭০টি মতো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ফেলেছে। ইরানের রকেট উৎক্ষেপণের জন্য চলমান লঞ্চিং বেস, বিমান-প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনাগুলোর বড়সড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেই সামরিক কমান্ডাররা জবাবি হামলার জন্য সময় নিচ্ছেন এখন। সংঘর্ষের গোড়ার দিকে ইরান যত ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছিল, এখন সেই সংখ্যাটা অনেকটাই কম দেখা যাচ্ছে।

যেসব বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে, তারা অবশ্য এটা স্বীকার করছেন যে, ইরানের 'মিসাইল সিটি'গুলো ইসরায়েলের জন্য এখনও বড়সড় ঝুঁকি।
বেন তেলেব্লু বলছেন, ‘এই ঘাঁটিগুলো নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু, কারণ এইসব জায়গা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হলে তা ইসরায়েলেই আঘাত করবে।’
‘এই ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে ইসরায়েলের হামলার জবাব দিতে ইরানের সামরিক সক্ষমতা অনেকটাই সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে’, বলছিলেন প্যাট্রিশিয়া ব্যাজিল্জিক।
সিএসআইএসের একটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই সপ্তাহে খোর্রামাবাদ, কার্মেনশাহ আর তাবরিজে তিনটি ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান আর ক্ষেপণাস্ত্র।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমএইচআর

