মধ্যপ্রাচ্যে যখন আগুন জ্বলছে, বোমার আঘাতে যখন শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, তখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত নির্বিকার। চুপ। নিরুত্তাপ। অথচ ভারতেরই সংবিধান, ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান একসময় মানবিকতা, শান্তি এবং নিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলত। আজ কী হলো সেই নীতির?
সম্প্রতি ইসরায়েল যখন ইরানের ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালাল, তখন বিশ্বের নানা দেশ থেকে প্রতিবাদ উঠেছে। এমনকি ভারতের ভেতর থেকেও কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধীদল এই আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা করেছে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার—বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—চূড়ান্ত নিরবতা পালন করেছে। এই নিরবতা কি কেবল কূটনৈতিক হিসাব? নাকি এটা ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির একটি বিপজ্জনক বাঁক?
বিজ্ঞাপন
নীতিহীন পক্ষপাত
ভারত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (SCO) সদস্য। এই সংস্থার লক্ষ্য আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতা। এই প্ল্যাটফর্মে ইরান, পাকিস্তান, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশ রয়েছে, যারা ফিলিস্তিন ও ইরানের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছে। অথচ এই একই মঞ্চে ভারত সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে—ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমর্থন না জানালেও ‘নীরব সমর্থন’ দিয়ে চলেছে।
ইরানের ওপর ইসরায়েলের চলমান হামলার নিন্দা জানিয়ে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) নিন্দা থেকে ভারত নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে, যা এই সংঘাতের কারণে প্রভাবশালী ইউরেশিয়ান রাজনৈতিক ব্লকের মধ্যে সম্ভাব্য ফাটলের ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছেন অনেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি দেশের নীতিগত অবস্থান তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন তা ক্ষমতাবানদের পাশেই কেবল দাঁড়ায়—সত্য বা ন্যায়ের পাশে নয়।
বিজ্ঞাপন
স্বার্থে আচ্ছন্ন কূটনীতি
ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সম্পর্ক বহু পুরনো। স্পাইওয়্যার, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র—সবই ভারত ইসরায়েল থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই সামরিক সম্পর্ক কি ভারতের ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে? অনেকে এটিকে নৈতিকতার বদলে স্বার্থনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি বলেই দেখছেন।
যদি তা-ই হয়, তাহলে সেটি ভারতের নৈতিক পতন বলেই বিবেচিত হবে।
ভারতের অবস্থান মুসলিম বিশ্বের প্রতি কী বার্তা?
ভারতের এই অবস্থান মুসলিম বিশ্বের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে— “আমরা তোমাদের অনুভূতির সঙ্গে দাঁড়াব না, যদি আমাদের অর্থনৈতিক বা প্রতিরক্ষা স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা কেবল কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটা ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রের বিরুদ্ধেও এক বড় আঘাত।
নিজ দেশেই প্রশ্নবিদ্ধ মোদির কূটনীতি
ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস ইসরায়েলের ইরান-হামলার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, এ ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের স্পষ্ট প্রতিবাদ করা উচিত ছিল।
ভারত সরকারের এই নীরব অবস্থানের বিপরীতে মুখ খুলেছে দেশটির প্রধান বিরোধীদল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।
আরও পড়ুন-
ইরানকে সহায়তার জন্য প্রস্তুত তুরস্ক
কংগ্রেস নেতা শশী থারুর ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ একাধিক নেতারা টুইট ও বিবৃতির মাধ্যমে ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা জানান এবং ভারতের সরকারকে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে আহ্বান করেন।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন-“একটি সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের উচিত ছিল নিরীহ মানুষের প্রাণহানির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানানো। সরকারের এই নীরবতা আমাদের আন্তর্জাতিক নীতির মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
গাজা ইস্যুতে ভারত জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে গত ১৪ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও এক্সে দেওয়া পোস্টে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি লেখেন, “যখন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিযানে নেমেছে, তখন আমরা শুধু নীরবই নই, বরং যখন তার সরকার ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে সে দেশের নেতৃত্বকে হত্যা করছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, তখনও আমরা প্রশ্নহীনভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছি।
প্রশ্ন উঠছে— আমরা কি একটি জাতি হিসেবে আমাদের সংবিধানের নীতি এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবোধকে বিসর্জন দিচ্ছি? সেই সংগ্রাম তো ছিল শান্তি, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে। যেই নীতিগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে ভারত বিশ্বমঞ্চে একসময় ন্যায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল— আজ সেই পথ থেকে সরে দাঁড়ানো কি আমাদের জন্য সম্মানজনক?”
দেশের ভেতর থেকেই যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন সরকার কি একবারও নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করবে না?
ভারত এখনো চাইলে তার পররাষ্ট্রনীতিকে মানবিকতার দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সামরিক সহযোগিতা বা কূটনৈতিক সম্পর্ক অমূল্য হতে পারে, কিন্তু তা কখনোই মানবতা, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার চেয়ে বড় নয়।
নীরব থাকা মানে সবসময় কূটনৈতিক ভারসাম্য নয়—কখনো কখনো তা ইতিহাসের কাছে অপরাধ হয়ে যায়।
—আল-জাজিরা, দ্য ডিপ্লোমেট, মিডল ইস্ট আই অবলম্বনে।

