বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫, ঢাকা

ভারত, পাকিস্তান ও ইরান-চীন তালেবানকে কাছে টানার নেপথ্যে কী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ মে ২০২৫, ০৭:৫৪ এএম

শেয়ার করুন:

ভারত, পাকিস্তান ও ইরান-চীন তালেবানকে কাছে টানার নেপথ্যে কী?

তালেবান সরকার আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার প্রায় চার বছর পার হলেও, এখন পর্যন্ত কোনো দেশ তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির বেশ তৎপর রয়েছেন। তিনি কাবুলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন, এরপর ইরান ও চীন সফর করেন এবং বেইজিংয়ে আবারও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। ২১ মে তিনি পাকিস্তান ও চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকেও অংশ নেন। এই দেশগুলোর সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক আগে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে, যা বর্তমানে সবচেয়ে সংকটজনক পর্যায়ে। সত্ত্বেও, আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও তালেবানের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। 

বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতিসংঘ কিংবা কোনো সদস্য রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও, এই ধরনের আঞ্চলিক কূটনৈতিক সংযোগ প্রমাণ করে আফগানিস্তান এখন আর বৈশ্বিক মঞ্চে একা নয়।


বিজ্ঞাপন


উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন আসে, কেন প্রতিবেশী দেশগুলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তাদের সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ভারত, পাকিস্তান ও ইরান সবাই তাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ নিচ্ছে।

তালেবানের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক যোগাযোগের টানেলে দেখা যায়, ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার কাবুল সফর করেন। সেখানে তারা আফগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে আফগান শরণার্থী প্রত্যাবাসন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর ৬ মে মুত্তাকি ও ইসহাক দার আবারও কথা বলেন, যা পাকিস্তানে ভারতের হামলার ঠিক আগের দিন। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পহেলগামে ২২ এপ্রিল বন্দুক হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দোষারোপ করে ভারত, এরপর চার দিন ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা পাল্টা হামলা চলে। ১৫ মে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মুত্তাকির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং পহেলগাম হামলার নিন্দা জানিয়ে তালেবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ১৭ মে মুত্তাকি তেহরানে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে বৈঠক করেন। ২১ মে বেইজিংয়ে পাকিস্তান ও চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন, যেখানে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল।

দোহার ভিত্তিক তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান সুহাইল শাহীন বলেন, তালেবান এখন আফগানিস্তানের বাস্তবতা, কারণ তারা দেশের সব ভূখণ্ড ও সীমান্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ করছে। আঞ্চলিক দেশগুলো এই বাস্তবতা মেনে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে, যা একটি বাস্তববাদী ও যুক্তিসংগত পদক্ষেপ। তিনি আরও বলেন, পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব এবং তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে দেরি করা উচিত নয়।

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে তালেবান একটি অসম্ভব অংশীদারিত্ব। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারত তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও রাখেনি। সে সময় পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। ভারত আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত মোহাম্মদ নজিবুল্লাহ সরকারের পক্ষে ছিল এবং তালেবানকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রক্সি বাহিনী হিসেবে দেখত। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারত আবার কাবুলে দূতাবাস চালু করে এবং আফগানিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী হয়। ভারত অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পানি সরবরাহে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে। তবে তালেবান ও তাদের মিত্রদের হামলার শিকার হয় ভারত। ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরও ভারত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তবে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করে এবং ২০২২ সালে আবার কাবুলে দূতাবাস চালু করে। ২০২৪ সালে তালেবান মুম্বাইয়ে আফগান কনস্যুলেটে একজন ভারপ্রাপ্ত কনসাল নিয়োগ দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত বুঝেছে আগের মতো তালেবানকে এড়িয়ে চললে প্রতিবেশী আফগানিস্তানের ওপর তার প্রভাব পাকিস্তানের কাছে চলে যাবে।


বিজ্ঞাপন


পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ১৯৯৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা তালেবানের অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। ২০২১ সালের পর পাকিস্তানে সহিংস হামলা বেড়েছে, যার জন্য তারা আফগান ভূখণ্ড থেকে পরিচালিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) গোষ্ঠীকে দায়ী করে। তালেবান তাদের আশ্রয় দিচ্ছে বলে পাকিস্তানের দাবি, যদিও তা তালেবান অস্বীকার করে। পাকিস্তান তালেবানের গোষ্ঠী থেকে আলাদা হলেও আদর্শিকভাবে তাদের কাছাকাছি মনে করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের আফগান শরণার্থীদের বহিষ্কার ও সীমান্ত বন্ধ রাখা সম্পর্কের এক বড় ইস্যু। তালেবান ইসলামাবাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চান, তবে সেটি পারস্পরিক হওয়া উচিত বলে তারা মনে করে।

ইরানের পক্ষ থেকে, তারা প্রথমবার তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং নর্দান অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করেছিল। ১৯৯৮ সালে তালেবানের হাতে কয়েকজন ইরানি কূটনীতিক নিহত হওয়ার পর ইরান সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছিল। ৯/১১ পর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় ইরান নীরবে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে এবং সীমিত সহায়তা দেয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলায় প্রয়োজন ছিল। ২০২১ সালে তালেবান আবার ক্ষমতায় আসার পর ইরান কাবুলের সঙ্গে নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা ও বাণিজ্য বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ইরান আফগানিস্তানে আইএসআইএস (আইএসআইএল)-এর শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসানের (আইএসকেপি) ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় সহযোগী খুঁজছে এবং আফগান শরণার্থী ও পানির সমস্যায় তালেবানের সহায়তা প্রয়োজন। ২০২৩ সালের মে মাসে সীমান্ত সংঘর্ষে দুই ইরানি সীমান্তরক্ষী ও একজন তালেবান যোদ্ধা নিহত হন। ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইরাবিম রাইসি তালেবানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যেন হেলমান্দ নদীর পানির প্রবাহে বাধা না দেয়।

বলা যায়— ভারত, পাকিস্তান ও ইরান প্রত্যেকেই নিজেদের কৌশলগত ও আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার জন্য তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও তারা বোঝে তালেবান আফগানিস্তানের বাস্তবতা এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। পারস্পরিক সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় কূটনৈতিক যোগাযোগই সমাধানের পথ বলে তারা বিশ্বাস করে। সূত্র: আল জাজিরা

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর