সম্প্রতি কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন সংকটে প্রবেশ করেছে। এই হামলা, যা ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র করেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত একদিকে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তান উন্মুক্ত হুমকি দিয়েছে, যদি পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে, তারা সর্বশক্তি প্রয়োগে দ্বিধা করবে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, শিমলা চুক্তির বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। পাকিস্তান, যেটি ভারতীয় অবস্থানের প্রতি ক্ষুব্ধ, জানিয়েছে—তারা শিমলা চুক্তি স্থগিত করার ব্যাপারে ভাবছে। যদিও চুক্তি নিয়ে সরাসরি কোনো চিঠি এখনও পাঠানো হয়নি, তবে এটি শ্রীঘ্রই ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
১৯৭২ সালের ২ জুলাই শিমলা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যেখানে দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে একটি স্পষ্ট অবস্থান তৈরি হয়েছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো একে অপরের সাথে এই চুক্তি সই করেছিলেন। এই চুক্তির প্রধান লক্ষ্য ছিল, যুদ্ধ পরবর্তী কাশ্মীর সমস্যার সমাধান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন।
শিমলা চুক্তি অনুযায়ী, কাশ্মীরের সমস্যা শুধু ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে। কাশ্মীরের জনগণের মতামত বা তৃতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়—এটাই ছিল চুক্তির মূল বিষয়। তবে পরবর্তীতে, পাকিস্তান শিমলা চুক্তির শর্তাবলী ভঙ্গ করে নানা ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছে, যার মধ্যে কাশ্মীরের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়া এবং ১৯৯৯ সালে কারগিল সংঘাতের মতো ঘটনা অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের সিদ্ধান্তে কাশ্মীর নিয়ে চুক্তির শর্তাদি কার্যত মান্য করা না হলে, পাকিস্তানও এই চুক্তি স্থগিত করার কথা ভাবছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন— যদি পাকিস্তান শিমলা চুক্তি স্থগিত করে, তবে এর ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের আরও তিক্ততা বাড়বে। এর প্রভাব শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং প্রতিবেশী দেশ যেমন বাংলাদেশ এবং চীনও এই পরিবর্তনগুলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
এছাড়া, ২০১৯ সালে ভারতের সংবিধান সংশোধন (ধারা ৩৭০ বাতিল) এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর নিয়ে ভারতের একটি একক অবস্থান তৈরি করার পর শিমলা চুক্তি কার্যত একপেশে হয়ে পড়েছে বলে অনেক কূটনীতিক মনে করেন। ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক অবতার সিং ভাসিন বলেছিলেন, শিমলা চুক্তি ছিল একটি ক্ষণস্থায়ী চুক্তি এবং কেবল যুদ্ধবন্দি প্রত্যাবর্তন ও সীমান্তে যোগাযোগ পুনরুদ্ধারের জন্য। কাশ্মীর ইস্যু সম্পর্কিত শর্তগুলো ছিল মূলত প্রতীকী এবং চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিল না।
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ জানিয়েছেন, তারা ভারতের সাথে থাকা সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি পর্যালোচনা করবে, যার মধ্যে শিমলা চুক্তি অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যন্ত, পাকিস্তান শিমলা চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো পদক্ষেপ নিলেও, এই বিষয়ের ওপর চাপ তৈরি করা হচ্ছে এবং এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন— যদি পাকিস্তান শিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে বা ভারতের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা অস্বীকার করে, তাহলে ভারতও তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে চুক্তির শর্তগুলো উপেক্ষা করতে পারে। এর ফলে, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যা দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
এছাড়া, পাকিস্তান-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি রয়েছে, যার মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সম্পর্কিত চুক্তি এবং ২০২১ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি অন্তর্ভুক্ত। এসব চুক্তি যদি ভঙ্গ হয়, তবে তার প্রভাব কেবল ভারত ও পাকিস্তানেই নয়, বরং বাংলাদেশ, চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েও পড়বে।
ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার পর পাকিস্তান জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে এবং যদি পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে, তাহলে তা যুদ্ধের উস্কানি হিসেবে গণ্য হবে। এই চুক্তি শুধু ভারত ও পাকিস্তান নয়, বরং বাংলাদেশ এবং চীনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পানি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের প্রভাব পুরো অঞ্চলে বিস্তৃত হতে পারে। সূত্র: দ্য হিন্দু
এইউ

