কাশ্মীরের পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে সম্প্রতি ভয়াবহ এক বন্দুকধারী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফের দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। নিহতদের মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় ও একজন নেপালের নাগরিক। ভারতের অভিযোগ—এই হামলায় পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও ভারতবিরোধী একাধিক পদক্ষেপ ঘোষণা করে। দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্ত, কূটনৈতিক বহিষ্কার, সীমান্ত ও আকাশসীমা বন্ধ, এমনকি পানি চুক্তি নিয়ে হুমকির ফলে গোটা উপমহাদেশে নতুন এক রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে।
গত মঙ্গলবার বিকেলে বৈসারণ উপত্যকায় সশস্ত্র হামলায় প্রাণ হারান নিরীহ পর্যটকেরা। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামের একটি সংগঠন, যা ভারতের মতে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার সহযোগী। হামলার পরপরই ভারতের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই হামলায় সরাসরি জড়িত দুই ব্যক্তি পাকিস্তানি নাগরিক। এ ঘটনাকে ভারত সরকার শুধুমাত্র একটি সন্ত্রাসী আক্রমণ হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করে।
বিজ্ঞাপন
হামলার পরদিন, বুধবার ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা–সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা। পাশাপাশি আটারি–ওয়াঘা সীমান্তপথ বন্ধ করা হয়। দিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামরিক উপদেষ্টাদের ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। হাইকমিশনের মোট কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০–এ নামিয়ে আনা হয়। একই সঙ্গে ভারতে অবস্থানরত সব পাকিস্তানি নাগরিকের ভিসা বাতিল করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে বলা হয়।
কাশ্মীর হামলার ঘটনার পর দেশজুড়ে যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, তার প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক জনসভায় কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, হামলায় যারা অংশ নিয়েছে এবং যারা এটি পরিকল্পনা করেছে, তারা কল্পনাতীত পরিণতি ভোগ করবে। তিনি বলেন, ‘যতটুকু জমি এই সন্ত্রাসীদের কবলে রয়েছে, সেটি ধুলিসাৎ করে দেওয়া হবে। ১৪০ কোটি ভারতবাসীর ইচ্ছাশক্তিই তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে।’
ভারতের এমন কড়া অবস্থানের পর গতকাল বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, ভারতের যেকোনো একতরফা পদক্ষেপ—বিশেষত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার মতো উদ্যোগ—আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। পাকিস্তানের দাবি, এই চুক্তি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সই হওয়া একটি বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যেখানে একতরফাভাবে স্থগিত করার কোনো সুযোগ নেই। পাকিস্তান আরও জানায়, সিন্ধু নদীর পানি দেশের ২৪ কোটি মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এই পানি প্রবাহ বন্ধের যেকোনো প্রচেষ্টা ‘যুদ্ধের শামিল’ হবে এবং এর জবাব জাতীয় শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারে দেওয়া হবে।
পাকিস্তান ভারতের পদক্ষেপকে ‘বেপরোয়া ও দায়িত্বহীন’ হিসেবে উল্লেখ করে জানায়, এতে আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছে। তাই পাকিস্তান ঘোষণা করে, ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিত রাখার অধিকার তারা প্রয়োগ করবে। শুধু সিমলা চুক্তিই নয়, কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘের প্রস্তাব কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত অন্য চুক্তিগুলোও কার্যকর থাকবে না।
বিজ্ঞাপন
এরপরই পাকিস্তানও বেশ কিছু পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। প্রথমেই তারা ভারতের সব সার্ক ভিসা বাতিল করে এবং জানায়, পাকিস্তানে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে। তবে শিখ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এই নির্দেশ শিথিল থাকবে। পাশাপাশি ওয়াঘা সীমান্তচৌকি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা বৈধভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে, তারা ৩০ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ত্যাগ করতে পারবে। এরপর আর সীমান্ত পথ খোলা থাকবে না।
পাকিস্তান ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতের প্রতিরক্ষা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাড়িয়ে দেয়। ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৩০ জনে নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে, যা ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে পাকিস্তান তার আকাশসীমা ভারতের সব বিমান সংস্থার জন্য বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান হয়ে ভারতের তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্যও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ অভিযোগ করেন, ভারত একটি ‘ছোটখাটো যুদ্ধ’ শুরু করেছে। তিনি বলেন, ভারতের হামলার মাত্রা বাড়লে পাকিস্তানও প্রস্তুত রয়েছে জবাব দিতে।
অন্যদিকে, ভারত ইতোমধ্যেই তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জানায়, পাকিস্তানি নাগরিকদের সব ধরনের ভিসা রোববার থেকে বাতিল বলে গণ্য হবে। শুধুমাত্র চিকিৎসা ভিসার ক্ষেত্রে মেয়াদ থাকবে মঙ্গলবার পর্যন্ত। পাকিস্তানের নাগরিকদের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশ ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ভারতের নাগরিকদের পাকিস্তান থেকে দ্রুত ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করার পর ভারতীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া জানায়, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চলাচলকারী সব ফ্লাইট এখন বিকল্প রুট ব্যবহার করবে।
কাশ্মীর অঞ্চলে হামলার পর ভারত বড় ধরনের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করেছে। গতকাল বসন্তগড় এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে বন্দুকধারীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে এক সেনা সদস্য নিহত হন। জম্মু–কাশ্মীরের পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে আজ শুক্রবার শ্রীনগর যাচ্ছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। সেখানে তিনি ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবেন।
হামলা ও পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাখ্যা দিতে বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে ২০টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বিকেলে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় বৈঠক, যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ এবং সংসদীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। বিরোধী পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, রাহুল গান্ধীসহ অন্যান্য দলের শীর্ষ নেতারা। বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে এবং প্রয়োজন হলে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ধ্বংসে আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে।
কাশ্মীর হামলার জেরে নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন শতাধিক মানুষ। তারা নানা স্লোগান দেন এবং ব্যারিকেড ভাঙারও চেষ্টা করেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ২০১৯ সালের সীমিত সামরিক সংঘাতের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এত বড় উত্তেজনা আর দেখা যায়নি। তার মতে—বর্তমান পরিস্থিতি দ্রুত সামাল না দিলে তা দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ভারতের ৪১ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হন। এর জবাবে ভারত পাকিস্তানের বালাকোট এলাকায় বিমান হামলা চালায়। এবারও পরিস্থিতি অনেকটা সেদিকেই গড়াচ্ছে বলে ধারণা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের। সূত্র: রয়টার্স
এইউ