আরব দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের জন্য সমর্থন জানিয়ে আসছে, তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতার দাবির পক্ষে কথা বলছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করা সব সময় সহজ হয়ে ওঠেনি। আরব দেশগুলোর মধ্যে এই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদক্ষেপ লক্ষণীয়। কিছু দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে খোলাখুলি সমর্থন জানিয়ে চলেছে, আবার কিছু দেশ নানা কারণেই সেসব সমর্থনের গতিপথ পরিবর্তন করেছে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেশ কিছু আরব দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে তাদের প্রতি সমর্থন দেখিয়ে আসছে। কিন্তু আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নিরাপত্তা সমস্যা এবং আঞ্চলিক সহিংসতা, এসব কারণে কখনো কখনো তাদের সমর্থন ফিলিস্তিনিদের জন্য কার্যকর হয়নি। ফিলিস্তিনিদের নিয়ে আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান নানা সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা একে অপরের সঙ্গে আলাদা আলাদা কৌশল অবলম্বন করেছে।
বিজ্ঞাপন
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ভিটে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বা তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই সময়ে বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্ডানে আশ্রয় নেন। এর পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) জর্ডানে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখান থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানোর উদ্যোগ নেয়। যদিও ১৯৭০ সালে এই বিষয়টি সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং জর্ডানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি লোককে লেবাননে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদিও ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতি দেশটির সমর্থন নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ছিল এবং সেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করা সহজ ছিল না।
লেবাননে, ১৯৭৫ সালে পিএলও যখন জর্ডান থেকে চলে এসে সেখানে আশ্রয় নেয়, তখন দেশটি বহুমুখী গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। লেবাননের খ্রিস্টান সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং ইসরায়েল তাদের শরণার্থী শিবিরগুলোতে হামলা চালায়। এসব হামলার মধ্যে সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে অন্তত ৮০০ বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যদিও ফিলিস্তিনিরা দাবি করেন, নিহতের সংখ্যা ছিল আরও বেশি। লেবানন সরকার ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার থাকলেও, তারা তাদের নাগরিক অধিকার দিতে রাজি হয়নি, কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে পাঠানো। এই নীতি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার সম্মুখীন হলেও লেবাননের অবস্থান অপরিবর্তিত ছিল।
মিসর, যা আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, ফিলিস্তিনের বড় সমর্থক হিসেবে পরিচিত। দেশটি বহুবার ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া এবং মধ্যস্থতায় ভূমিকা রেখেছে। ২০০৭ সালে হামাস গাজা শাসন শুরু করার পর, মিসর গাজা এবং সিনাই উপদ্বীপের মধ্যে নিরাপত্তা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ১৯৭৯ সালে মিসরই প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তবে গাজা উপত্যকায় হামাসের শাসন ক্ষমতায় আসার পর মিসরের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে, কারণ গাজায় হামাসের উত্থান মিসরের রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এর ফলে আরব দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রথম দেশ হিসেবে ইউএইর নাম উঠে আসে। এই চুক্তির মাধ্যমে আরব দেশগুলোর মধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার রীতি ভেঙে ফেলা হয়, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় আঘাত হিসেবে দেখা গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরায়েলের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে, এবং দুটি দেশ একে অপরকে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করছে।
বিজ্ঞাপন
সুদান ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সম্মত হয়, যদিও ১৯৬৭ সালে সুদান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে ‘থ্রি নো’ নীতির ঘোষণা দিয়েছিল। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য সুদান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে, যা তাদের ‘সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক’ তালিকা থেকে বাদ দেয়। এই চুক্তি সুদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে।
কুয়েত এবং ইরাকের অবস্থানও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কুয়েতের সঙ্গে ফিলিস্তিনির সম্পর্কের ইতিহাস তিক্ত, কারণ ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের আক্রমণের প্রতি ইয়াসির আরাফাত সমর্থন জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কুয়েত আরাফাতের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ করে দেয়। তবে, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন শাসনামলে ফিলিস্তিনিরা সেখানে বিশেষ সুবিধা পেত। সাদ্দামের পতনের পর ইরাকে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা সহিংসতা ও দমন-পীড়নের শিকার হয় এবং অনেককে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়।
ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরব দেশগুলোর অবস্থান এবং কৌশল কখনো কখনো পরিবর্তিত হয়, কারণ তাদের রাজনৈতিক, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব দেশের সমর্থন সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম একীভূত হয়নি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। সূত্র: রয়টার্স
এইউ

