মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স.) কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার পর থেকে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা। পেশায় একজন আইনজীবী। তবে বিশ্বজুড়ে এখন আলোচনায় আসলেও ভারতে তিনি আগে থেকেই আলোচিত এবং বিতর্কিত। বিজেপির ও কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রচারণা করেই মূলত তিনি দলটির শীর্ষে পৌঁছান।
উইকিপিডিয়া ও ওয়ান ইন্ডিয়ার তথ্যে দেখা যায়, নয়াদিল্লিতে ২৩ এপ্রিল, ১৯৮৫ সালে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নূপুর শর্মা। তার বাবার নাম বিনয় শর্মা। তবে সেখানে মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়নি। ৩৭ বছরের এই বিতর্কিত রাজনীতিবিদ এখনো বিয়ে থা করেননি।
বিজ্ঞাপন
ছাত্রজীবন থেকেই বাকপটু নূপুর ছিলেন ভারতে ধর্মীয় বিভাজনের কেন্দ্রে থাকা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) এর অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) এর ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। এরপর তিনি বিজেপির যুব শাখা ভারতীয় জনতা যুব মোর্চায় (বিজেওয়াইএম) কাজ শুরু করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ হিন্দু কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক নূপুর পরে আইনের ডিগ্রিও অর্জন করেন। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে আইনে স্নাতকোত্তরও করেছেন তিনি।
২০২০ সালে বিজেপির বর্তমান সভাপতি জে পি নাড্ডা দলের জাতীয় মুখপাত্র হিসেবে নূপুর শর্মাকে দায়িত্ব দেন। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগে সম্প্রতি তাকে ভারতীয় রাজনীতিতে একজন উদীয়মান তারকা হিসেবেই দেখা হত।
২০১৫ সালের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টির (এএপি) প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে নিউ দিল্লি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নূপুর। তবে এই নির্বাচনে কেজরিওয়ালের কাছে হেরে যান।
গত কয়েক বছরে ভারতের টিভি দর্শকদের কাছে অতি পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন নূপুর শর্মা। বেশিরভাগ সন্ধ্যাতেই টিভি ছাড়লে পর্দায় শোনা যেত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে উচ্চকণ্ঠে তার চিৎকার এবং বিরোধী রাজনীতিকদের কোণঠাসা করতে নানা কৌশলের ব্যবহার- এমনকি তাদের প্রতি গালিগালাজ।
বিজ্ঞাপন
তার সমর্থকদের সম্প্রতি টুইটারে শেয়ার করা একটি ছোট ক্লিপে তাকে একজন প্যানেলিস্টকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায় আপনি একজন 'ব্লাডি হিপোক্রেট অ্যান্ড অ্যা লায়ার' (ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী) এরপর তিনি তাকে বলেন 'শাট আপ'। এই ভিডিও ক্লিপটি ব্যাপক শেয়ার হয়।
এর আগেও একাধিকবার বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন এই কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেত্রী। ২০০৮ সালের নভেম্বরে সংসদ হামলায় অভিযুক্ত এসএআর গিলানিকে হেনস্থা করার অভিযোগ ওঠে এই বিজেপি নেত্রীর বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য আদালতে বেকসুর খালাস পেয়ে যান। সংসদ হামলায় অভিযুক্ত অধ্যাপক গিলানির মুখে থুতু ছিটিয়ে ছিলেন নূপুরের সঙ্গী। সেই সময়ই খবরের শিরোনামে উঠে আসেন এই বিজেপি নেত্রী।
বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য নূপুরের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র, হায়দরাবাদে একাধিক এফআইআর হয়েছে ইতিমধ্যেই। ২০১৭ সালে কলকাতা পুলিশ তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উস্কানি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগ আনে।
২৬ মে টেলিভিশন বিতর্কে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স.) কে নিয়ে আক্রমণাত্মক ও অসম্মানজনক মন্তব্য করেন নূপুর শর্মা। এই ঘটনায় শুরুতে বিজেপি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং উত্তর প্রদেশের কানপুরে মুসলিমরা বিক্ষোভ করলে পুলিশ তাদের দমন করে। ওই দাঙ্গায় ৪০ জনের বেশি আহত হয় এবং সহিংসতায় জড়িত অভিযোগে দেড় হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ মুসলিমদের গণগ্রেফতারের পাশাপাশি তাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়।
তবে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর কঠোর বার্তা দেয়ার পর নিজেদের চেহারা পুরোটাই পাল্টে ফেলেছে বিজেপি। নূপুর শর্মাকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি দলটি দাবি করেছে, তার মন্তব্যের সঙ্গে বিজেপির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সমালোচকরা বলছেন, বিজেপি যতই দাবি করুক নূপুর শর্মা মূলস্রোতের বাইরের কেউ, তিনি মোটেই তা নন। তিনি বিজেপির দলীয় মুখপাত্র, দলের মতামত তুলে ধরা তারই দায়িত্ব। বিজেপির কথাই তার মুখ দিয়ে বের হয়।
উপসাগরীয় দেশ কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইনের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, মালদ্বীপ, জর্ডান, লিবিয়াও ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে। কুয়েতে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইরান, কুয়েত ও কাতার ওই ঘটনায় নিন্দা জানাতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। সৌদি আরব কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে।
উপসাগরীয় এবং এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এ মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় ভারতীয় কূটনীতিকরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও ঝড়ের যে আরও অনেকখানি বাকি তা টের পাওয়া যাচ্ছে।
বিতর্কিত ওই মন্তব্যের জেরে ৫৭ সদস্যের অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) এবং পাকিস্তানও ভারতের সমালোচনা করেছে। দিল্লি অবশ্য ওআইসি ও পাকিস্তানের সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, তাদের মন্তব্য ‘অবাঞ্ছিত ও সংকীর্ণচিত্তের’।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামলাতে এখন বিজেপি ও সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া লাগতে পারে। তা না হলে আরব বিশ্ব ও ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, এনডিটিভি, আনন্দবাজার
একে