বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট উপহার নিয়েছেন- নিজের বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগ ওঠার পর তা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা (ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাডভাইজার অব মিনিস্ট্রিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস) লাউরি ম্যাগনাসের কাছে সোমবার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন টিউলিপ।
চিঠিতে টিউলিপ লিখেছেন, গত কয়েক সপ্তাহে আমি গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু হয়েছি, যার অনেক কিছুই সঠিক নয়। যেখানে আমার আর্থিক ও আমার পরিবারের বাংলাদেশের সাবেক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উঠে এসেছে। আমি একদম স্পষ্ট যে আমি কিছু ভুল করিনি। যাইহোক, সন্দেহ এড়ানোর জন্য আমি চাই আপনি স্বাধীনভাবে এগুলো নিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করবেন।
বিজ্ঞাপন
লাউরি ম্যাগনাস উপদেষ্টা হিসেবে মন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের বিষয়টি দেখভাল করেন। এখন ম্যাগনাস তদন্ত করে দেখবেন- মন্ত্রী হিসেবে টিউলিপ কোনো বিধি লঙ্ঘন করেছেন কিনা। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) টিউলিপ সিদ্দিক। দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে আছেন তিনি। টিউলিপ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে লন্ডনের কিং’স ক্রস এলাকায় অবস্থিত ২ শয্যাকক্ষের একটি ফ্ল্যাট ২০০৪ সালে টিউলিপ সিদ্দিককে আবদুল মোতালিফ নামের এক ডেভেলপার উপহার দিয়েছিলেন বলে জানানো হয়। মোতালিফ বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এবং টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
বিজ্ঞাপন
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ কোটি ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা) দিয়ে ২০০১ সালের জানুয়ারিতে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন আবদুল মোতালিফ। বেশ সস্তাতেই পেয়েছিলেন তিনি, কারণ একই বছর আগস্ট মাসে সেই ফ্ল্যাটটির পার্শ্ববর্তী আরেকটি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯ কোটি ৭৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা)।
যুক্তরাজ্যের ইলেক্টোরাল রোল ডেটার তথ্য বলছে, ২০০৪ সালে উপহার হিসেবে পাওয়ার পর কিং’স ক্রসের সেই ফ্ল্যাটটিতে কয়েক বছর ছিলেন টিউলিপ। এরপর তার অন্য ভাই-বোনরা ছিলেন আরও বেশ কয়েক বছর। বর্তমানে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছেন টিউলিপ। সেখান থেকে বাৎসরিক ৯০ হাজার পাউন্ড (১ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা) উপার্জন হচ্ছে তার।
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ পর্যন্ত লেবার পার্টির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্য শাখার ‘লবিং ইউনিট অ্যান্ড ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি টিম’-এ সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। তার নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রেও এ সংশ্লিষ্টতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
তবে কোনও নির্বাচনী হলফনামায় ফ্ল্যাটটির বিষয়ে উল্লেখ করেননি টিউলিপ। হলফ নামায় তিনি যুক্তরাজ্যের হাইগেট এবং হ্যাম্পস্টেড এলাকার ফ্ল্যাটের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। ৭০ বছর বয়সী আবদুল মোতালিফ বর্তমানে পূর্ব লন্ডনে মুজিবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে থাকেন। মুজিবুল ইসলাম আওয়ামী লীগের একজন সাবেক এমপির সন্তান।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। মুজিবুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, তিনি ফ্ল্যাটটি ২০০১ সালে কিনেছিলেন। কিন্তু আর কোনও তথ্য জানাননি তিনি।
লন্ডনের ভূমি রেজিস্ট্রি রেকর্ডে দেখা যায়, ২০০৪ সালের নভেম্বরে তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটির একক মালিক হন টিউলিপ সিদ্দিক। আর তখন তিনি কেবল লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছিলেন এবং তার কোনও উপার্জন ছিল না। ফ্ল্যাটটির কোনও মর্টগেজও ছিল না এবং এর কোনও দামও উল্লেখ ছিল না। এর ফলে ফ্ল্যাটটি যে কেনা হয়নি এবং তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল, সেটির প্রমাণ মিলেছে। ফ্ল্যাট কেলেঙ্কারির এই ঘটনায় যুক্তরাজ্যে টিউলিপ সিদ্দিকের ওপর পদত্যাগের চাপ জোরালো হয়েছে।
টিউলিপ সিদ্দিক কোনো অন্যায় করেননি দাবি করলেও, কীভাবে তিনি কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটটির মালিক হলেন– তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। মেইল অন সানডে জানিয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিক প্রাথমিকভাবে দাবি করেছেন, ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা কিনেছেন। তবে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফ্ল্যাটটি কোনো অর্থের লেনদেন ছাড়াই টিউলিপকে দিয়েছেন আবদুল মোতালিফ নামে একজন আবাসন ব্যবসায়ী।
ব্রিটেনের এমপিরা দাবি জানিয়ে বলেছেন, টিউলিপ সিদ্দিক যদি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে না পারেন, তাহলে তার মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।
এফএ

