ইন্টারলকিং গিয়ার মাধ্যমে নির্মিত মেক ইন ইন্ডিয়ার আইকনিক সিংহ লোগোটি বিগত দশ বছর ধরে ভারতের শিল্পশক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে জাতি এখন এক উত্পাদন বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।
২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বৃহৎ প্রকল্পটির সূচনা করেন এবং সেই থেকে এটি কেবল একটি সরকারি কর্মসূচি নয়, বরং এক জাগরণের বার্তা যা ভারতের অর্থনীতি এবং বিশ্বের চোখে ভারতের ভাবমূর্তিকে পরিবর্তন করেছে। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার: ভারতকে বিশ্বের উত্পাদন কেন্দ্রে পরিণত করা, বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এই বিস্তৃত প্রোগ্রামের মাধ্যমে, ভারতের অর্থনীতি ইতিহাসের দ্রুততম হারে বৃদ্ধি পেতে পারে, যা স্থানীয় শিল্পকে উল্লেখযোগ্যভাবে বার্ধিত করবে এবং বিনিয়োগের জন্য দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।
বিজ্ঞাপন
সাফল্যের গল্পের সাক্ষী কিছু শক্তিশালী পরিসংখ্যান। ২০১৪ সালে ভারতের জিডিপিতে উত্পাদন খাতের অবদান ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে ১৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্ব উত্পাদন কেন্দ্র হিসেবে ভারতের উত্থান স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের রূপান্তরে। যেমন গুজরাটের জিআইএফটি সিটি এবং তামিলনাড়ুর উদীয়মান সেমিকন্ডাক্টর হাব। এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো নয়ডার মোবাইল উত্পাদন কেন্দ্র হিসেবে বিকাশ:
- ২০১৪ সালে মাত্র ২টি মোবাইল ফোন উত্পাদন ইউনিট থেকে ২০২৪ সালে তা ২০০টির বেশি হয়েছে।
- উত্পাদন ২০১৪-১৫ সালে ৬ কোটি ইউনিট থেকে ২০২২-২৩ সালে ৩.১ বিলিয়ন ইউনিটে পৌঁছেছে।
- ভারত আমদানিকারক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন উৎপাদক হিসেবে পরিণত হয়েছে।
নীতি সংস্কার এবং মেক ইন ইন্ডিয়া প্রোগ্রামের অধীনে কৌশলগত উদ্যোগ দ্বারা চালিত ভারত ক্রমাগত জিডিপিতে উত্পাদনের শতাংশ ২৫ শাতংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এই প্রচারাভিযান বিভিন্ন শিল্পের বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে ভারতে তাদের উত্পাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে প্রলুব্ধ করেছে। যেমন ইলেকট্রনিক্স, টেক্সটাইল, প্রতিরক্ষা এবং অটোমোবাইল। দেশের শক্তিশালী শ্রমশক্তি, সুবিধাজনক অবস্থান এবং আকর্ষণীয় সরকারি প্রণোদনার কারণে ফক্সকন, স্যামসাং, বোয়িং এবং হুন্ডাইয়ের মতো কোম্পানিগুলো ভারতে তাদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
মেক ইন ইন্ডিয়ার সফলতা সম্প্রতি বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গয়াল তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছেন, ভারত এখন বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগ এবং শিল্পের জন্য একটি শীর্ষস্থানীয় স্থান হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কোম্পানিগুলো ভারতে বিভিন্ন শিল্পের জন্য তাদের উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে আগ্রহী। এর ফলে, ভারত শুধু স্থানীয় উত্পাদনের জন্য একটি প্রিয় গন্তব্য নয় বরং বৈশ্বিক বাজারেও একটি প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
মেক ইন ইন্ডিয়ার প্রধান মাইলফলক সমূহ
রেকর্ড-ব্রেকিং এফডিআই প্রবাহ: এপ্রিল ২০০০ থেকে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত, ভারত রেকর্ড ৯৯০.৯৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে। বিশেষত, গত দশ বছরে (এপ্রিল ২০১৪ থেকে মার্চ ২০২৪) মোট এফডিআই প্রবাহের প্রায় ৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ৬৬৭.৪১ বিলিয়ন ডলার ভারতে এসেছে। এই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির হার ভারতের প্রতি বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বৃদ্ধির প্রমাণ, যা নীতিমালা উন্নয়ন, প্রণোদনা এবং বিনিয়োগ সহায়ক পরিকাঠামোর মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং চাকরি সৃষ্টি: মেক ইন ইন্ডিয়ার আওতায় কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত প্রায় ৩৬ শতাংশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়কালে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারতের অর্থনীতির দৃঢ়তা ও কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
ব্যবসা সহজীকরণের জন্য সংস্কার: ভারত সরকার ব্যবসার জন্য বিনিয়োগকারী বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ৩ হাজার ৫০০টিরও বেশি কমপ্লায়েন্স ডিক্রিমিনালাইজ করা হয়েছে এবং ৪০ হাজারটিরও বেশি কমপ্লায়েন্স সহজীকৃত করা হয়েছে, যা নাগরিক প্রসিকিউশন সম্পর্কে উদ্বেগ কমিয়েছে। এই নিয়ন্ত্রক সংস্কারগুলি দেশি এবং বিদেশি ব্যবসার জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে, যা শিল্প বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
এই মাইলফলকগুলির মাধ্যমে মেক ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচি শিল্প বিকাশ, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে এবং ভারতকে বৈশ্বিক উত্পাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে।
ভারতের নতুন শিল্প প্রেক্ষাপট
মেক ইন ইন্ডিয়া যেমন দেশের শিল্প প্রেক্ষাপটকে পুনর্গঠন করছে, তেমনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত চমকপ্রদ পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে, যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করছে।
ভারতের অর্থনীতির ভিত্তি বলে বিবেচিত ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই) খাতটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের গল্প। উদ্যম ওয়েবসাইটের মতো প্রোগ্রামের সূচনা, যা জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত ৪.৭ কোটিরও বেশি নিবন্ধন পেয়েছে এবং ঋণ প্রবাহের তীব্র বৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ছোট ও মাঝারি ব্যবসাকে ক্ষমতায়িত করেছে।
এছাড়াও প্রতিরক্ষা উত্পাদন খাতেও বিশাল অগ্রগতি হয়েছে। যেখানে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে রফতানির নেতৃত্বে উত্তরণ ঘটেছে। ভারতের প্রতিরক্ষা রফতানি ২০২৩ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৯২০ কোটি রুপি থেকে ২০২৪ অর্থবছরে ৩২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২১ হাজার ০৮৩ কোটি রুপিতে পৌঁছেছে।
প্রোডাকশন লিংকড ইনসেনটিভ (পিএলআই) স্কিমটি ভারতের শিল্প নীতির একটি স্তম্ভে পরিণত হয়েছে এবং মেক ইন ইন্ডিয়া ২.০-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দকৃত ১.৯৭ লাখ কোটি রুপিসহ (২৬ বিলিয়ন ডলার) পিএলআই প্রকল্পটি ২০২৫-২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৩.৩৫ লাখ কোটি রুপির আউটপুট সরবরাহ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রকল্পে বড় আকারের বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়েছে, যা ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল এবং ওষুধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতকে বৈশ্বিক উত্পাদন কেন্দ্রে পরিণত করতে সাহায্য করছে।
উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি
মেক ইন ইন্ডিয়া উদ্যোগের মাধ্যমে উত্পাদন শিল্পে একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটেছে। ভারত এখন ডিজিটাল উত্পাদনের ক্ষেত্রে এক নেতা হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে ২০২৩ সালের মধ্যে বেশিরভাগ ভারতীয় উদ্যোগ ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) খাত আরও উৎপাদনশীল উত্পাদন কৌশলের দরজা খুলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে মানদণ্ডে পরিণত করেছে।
সরকারি উদ্যোগগুলি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করছে
ভারত সরকার উৎপাদন ক্ষেত্রে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম চালু করেছে। যেখানে বিশেষভাবে ডিজিটাল রূপান্তরের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারা দেশে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ (C4i4) ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে, যা ডিজিটাল উত্পাদনে উন্নতি সাধনে সহায়তা করছে। এছাড়াও, শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচারণা বিভাগ (DPIIT) স্টার্টআপ ইন্ডিয়া উদ্যোগের আওতায় উৎপাদন-কেন্দ্রিক স্টার্টআপগুলিকে সক্রিয়ভাবে অর্থায়ন করেছে, যা খাতে উদ্যোক্তৃত্বকে উৎসাহিত করছে।
সূত্র: নিউজ বোম্ব
এমএইচএম

