শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

বাল্টিকের গলার কাঁটা ‘কালিনিনগ্রাদ’

তাসীন মল্লিক
প্রকাশিত: ০৭ মে ২০২২, ০৫:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

বাল্টিকের গলার কাঁটা ‘কালিনিনগ্রাদ’
ছবি: সংগৃহীত

জার্মান খলনায়ক হিটলারের একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত গলার কাটায় পরিণত হয়েছে বাল্টিক সাগর তীরবর্তী দেশগুলোর। ১৯৩৯’র নন-আগ্রেসন চুক্তি ভঙ্গ করেছিলেন এডলফ হিটলার, অপরিণামদর্শী উন্মত্ত ষাঁড়ের মত সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসেন তিনি। ফলস্বরূপ বলশেভিক ভালুক জোসেফ স্তালিনের সমরনীতির কাছে পরাস্ত হয়ে, বাল্টিক সাগর ও পূর্ব ইউরোপে জার্মান আধিপত্য বজায় রাখার দুর্গ কোনিসবার্গ হারিয়ে বসেন। সোভিয়েতরা যার নাম দিয়েছে কালিনিনগ্রাদ।

Kaliningrad port
কালিনিনগ্রাদ বন্দর, শীতকালে কৃষ্ণ সাগরতীরবর্তী এ বন্দর ব্যবহার করে থাকে রাশিয়া।

বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস

কোনিসবার্গ, প্রুশিয়া তথা জার্মান সাম্রাজ্যের মধ্যযুগীয় রাজধানী। ভৌগোলিক কৌশলগত বন্দর নগরীটি ছিল প্রুশিয়ার অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির কাছে হেরে এ গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হারিয়ে বসেন তৎকালীন প্রধান দ্বিতীয় কাইজার উইলহেম। ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তিতে সই করে পশ্চিম কোনিসবার্গের নিয়ন্ত্রণ পোল্যান্ডের হাতে তলে দেন তিনি।

এরপর কয়েক দশকে জার্মানিতে চরম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। জার্মানির ক্ষমতা দখল করে নাৎসি বাহিনী প্রধান এডলফ হিটলার। পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ভার্সাই চুক্তির শর্ত একের পর এক ভাঙতে থাকেন তিনি। ১৯৪২ সালে পোল্যান্ড দখল করে নেয় নাৎসি বাহিনী। জার্মানির সাথে পুনরায় একীভূত হয় কোনিসবার্গ। বন্দরটিতে শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে জার্মান আধিপত্য বজায় রাখার দুর্গ গড়ে তুলেন হিটলার।

তবে আগ্রাসী হিটলার যেন ছুটছিলেন অন্ধ ষাঁড়ের মত। ১৯৪১ সালের ২২ জুন, ১৯৩৯ সালের জার্মানি-সোভিয়েত নন-আগ্রেশন চুক্তি ভঙ্গ করে বসেন হিটলার। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেন তিনি। চার বছর ধরে সোভিয়েতদের বিশাল ভূখণ্ড দখলে নিতে সক্ষম হয় নাৎসি বাহিনী। তবে ‘দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষের ক্ষমতা হ্রাস করা’ ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্র নায়ক জোসেফ স্তালিনের একটি কৌশল। ১৯৪৫ এর এপ্রিলে রক্ত জমানো ঠাণ্ডার শহর স্তালিনগ্রাদে সোভিয়েত লাল বাহিনীর কাছে পরাজিত হন হিটলার। চূর্ণবিচূর্ণ হয় কোনিসবার্গের প্রতিরোধ, শহরটি দখলে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরের বছর বলশেভিক পার্টির সদস্য এবং সোভিয়েত বিপ্লবের অন্যতম নায়ক মিখাইল ইভানোভিচ কালিনিনের নামে শহরটির নামকরণ করা হয় কালিনিনগ্রাদ।


বিজ্ঞাপন


mijhail kalinin
মিখাইল ইভানোভিচ কালিনিন।

বাল্টিকের গলার কাটা

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয় তিন বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া। সার্বভৌমত্ব লাভ করে পোল্যান্ড। উল্লেখ্য কৃষ্ণ সাগর তীরে লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মধ্যবর্তী সমুদ্রতীরবর্তী ভূখণ্ডই কালিনিনগ্রাদ। ১৯৪৫ এর পর থেকে ভূখণ্ডটি রুশদের দখলে রয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক জোটের ভূমিকা অজানা নয়। সোভিয়েত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ড যোগ দেয় ন্যাটো সামরিক জোটে। এরপর রাশিয়ার সাথে বাল্টিক রাষ্ট্র এবং পোল্যান্ডের দহরম মহরম শুরু হয়। কালিনিনগ্রাদে বিশাল সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে রাশিয়া।

সম্প্রতি চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমাদের পদক্ষেপের সাথে বাল্টিক রাষ্ট্র এবং পোল্যান্ডের সংহতিতে ক্ষুদ্ধ হয়েছে রাশিয়া। ইতোমধ্যে ইউরোপের সঙ্গে চুক্তি ভেঙ্গে কালিনিনগ্রাদে পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ১৪ এপ্রিল রুশ নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভও কড়া হুশিয়ারি দিয়েছেন এ বিষয়ে।

ফলে ইউক্রেন ইস্যুতে এক পা এগিয়ে দু’পা পিছিয়ে যাচ্ছে বাল্টিক দেশগুলো। কালিনিনগ্রাদ যেন তাদের গলায় আটকে আছে বিষাক্ত কাটা হিসেবে। শুধু লিথুনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়াই নয় সমগ্র পূর্ব ইউরোপ জুড়ে যেন প্রলয়ের স্ফুলিঙ্গ কালিনিনগ্রাদ সুপ্ত হয়ে বসে রয়েছে।

iskandar missile
কালিনিনগ্রাদে মোতায়েনকৃত ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র।

ইউরোপের সর্ববৃহৎ সামরিক ঘাঁটি?

কালিনিনগ্রাদে পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন থেকে বিরত থাকতে ইউরোপের সাথে রয়েছে রাশিয়ার চুক্তি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডটিতে হেন কোন সামরিক অস্ত্র মোতায়েনের বাকি নেই রাশিয়ার। আনুমানিক হিসেবে কালিনিনগ্রাদে মোতায়েন রয়েছে অন্তত ২০ হাজার রুশ সৈন্য।

ভূখণ্ডটির নিকটস্থ কৃষ্ণ সাগর তীরে ৫৮টি রুশ নৌ ইউনিট রয়েছে জলসীমা পাহাড়ায়। ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাবমেরিন, প্রতিরক্ষা মিসাইল রয়েছে ইউনিটগুলোতে। মোতায়েন রয়েছে বিভিন্ন মডেলের ৮০০ ট্যাংক। ১ হাজার ২০০ সাঁজোয় যান, ৩৪৫টি আর্টিলারি এবং ২০০ বিমান রয়েছে সামরিক ঘাঁটিটিতে।

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন গোপনে কালিনিনগ্রাদে পরমাণু অস্ত্রও মোতায়েন করেছে রাশিয়া। সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ ও রয়েছে ঘাঁটিটিতে। রুশ ব্যালিস্টিক মিসাইল ইস্কান্দার এবং অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এটুএডিও রয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেক সমর বিশেষজ্ঞরা। বিপুল এ সমারিক উপস্থিতির জন্য কালিনিনগ্রাদকে ইউরোপের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি বলে দাবি করেন অনেকেই। তবে অতি গোপনীয় সামরিক কার্যক্রম এবং সীমিত তথ্য সরবরাহ কালিনিনগ্রাদ সম্পর্কে শুধু ধোঁয়াশাই তৈরি করেছে।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর