প্রায় ৮ কোটি মানুষের প্রাণ হরণ করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ কারণেই ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের খেতাব পেয়েছে এটি। নির্বিচারে গণহত্যা, হলোকাস্ট, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগসহ নানা ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসংখ্যানে যুক্ত হয়েছে। হৃদয় বিদারক হলেও বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় স্থান পায়নি ‘বিচ্ছেদ’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শারীরিক-মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করেছিল অগনিত যুগলকে। সাম্রাজ্যবাদী কোনো শক্তির বোমার আঘাতে কেউ হয়ত তার প্রিয়তমাকে রেখে একাই স্বর্গের সিড়িতে উঠেছেন। হয়ত কোনো দখলদার হানাদারের লালসায় হারিয়ে গেছে কারও প্রিয়তমা। আবার হয়ত বাস্তুচ্যুতিতে দুজনেই দু’দিগন্তে ছুটেছে, এরপর শুধু পরস্পরের অপেক্ষা।
বিজ্ঞাপন
১৯৪৪ সালের বসন্তে একে অপরের পলক বন্দী হন মার্কিন বিমান বাহিনীর এয়ারবর্ন ডিভিশনের সাবেক অভিজ্ঞ সেনা নরউড থমাস এবং ব্রিটিশ নাগরিক জয়েস ডুরান্টের। লন্ডনের বাইরে যখন প্রথম তাদের দেখা হয় নব প্রণয়ের আকুলতাকে উপেক্ষা করতে পারেননি তারা। সে আকুলতা অগ্রাহ্যের ক্ষমতা হয়নি ২১ স্পর্শ করা নরউড থমাস এবং সদ্য ষোড়শী ডুরান্টের।
স্বয়ং থমাসের বয়ানেই স্পস্ট হয়েছে প্রবল আগ্রহের বিষয়টি। ডুরান্টের সাথে প্রথম দেখার দিনটি স্মরণ করে থমাস বলেন, ‘‘আমি এক বন্ধুর সাথে বাইরে ছিলাম, এবং অল্পবয়সী হওয়ায় আমাদের চোখ তরুণীদের দিকে ছিল। আমরা টেমস পার হওয়ার জন্য একটি সেতুতে ছিলাম। যখন আমরা নিচের দিকে তাকালাম, দুই সুন্দর যুবতীকে দেখলাম।’’
প্রথম দেখাতেই ডুরান্টের ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না তিনি। থমাসের বয়ানে – সে যেভাবে হাসছিল আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম, সবসময় তার দিকে থাকতাম। ভাবতাম, ‘ঈশ্বর! এত মিষ্টি মেয়ে’।
বিজ্ঞাপন
প্রথম দেখার পর শুরু হয় থমাস-ডুরান্ট জুটির নাতিদীর্ঘ প্রেম। থমাসের ভাষ্য অনুযায়ী মাত্র দুইমাসের মধ্যেই নিজেকে প্রেমের ‘উচ্চ শিখরে’ খুঁজে পান।
বিচ্ছেদ
বছর গড়িয়ে আসে জুন। ওই মাসের ৬ তারিখ নরম্যান্ডির যুদ্ধে থমাসের দায়িত্ব পড়ে ফ্রান্সে। মোবাইল প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছিল আরও ২৯ বছর পরে। যুদ্ধক্ষেত্রে ফুরসত নেই আহারের, সেখানে টেলিগ্রাফের আবদার রীতিমত অপরাধ।
শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নেদারল্যান্ডসের মার্কেট গার্ডেনে দুর্ধর্ষ গ্লাইডিং অভিযানে অংশ নেন থমাস। ৪৫’এ যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন অক্ষশক্তি বুলগেরিয়ার আর্টিলারি থেকে ছোড়া গোলার আঘাতে।
থমাস এবং ডুরান্টের মাঝে হাজার ক্রোশের পথ নির্মাণ করে যুদ্ধ।
যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান থমাস, হন্যে হয়ে খোঁজতে শুরু করেন ডুরান্টের। যোগাযোগের একমাত্র উপায় চিঠি। ডুরান্টের ঠিকানায় লেখা চিঠির উত্তর আসে।
উত্তরে বেদনাহত হন থমাস। তিনি বলেন ‘‘আমরা অল্প সময়ের জন্য চিঠির মাধ্যমে চিঠি লিখেছিলাম এবং আমি তাকে কয়েকটি উপহারও পাঠিয়েছিলাম।’’
চিঠির উত্তরে ডুরান্ট জানান তিনি সদ্যই নার্সিং পেশায় মনোনিবেশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে পুর্নমিলন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় ডুরান্ট। হৃদয় ভেঙে যায় থমাসের।
দুজনেই এরপর ভিন্ন ব্যক্তির সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। ২০০১ সালে লিম্ফোমায় মৃত্যুবরণ করে থমাসের জীবন সঙ্গী।
প্রেম যেন পুরানের পাখি
পুরানের পাখি ফিনিক্স। মৃত্যুর পর আগুন থেকে পুর্নজন্ম নেয় সে। থমাস-ডুরান্টের প্রেমাখ্যান ফিনিক্সের মতই আবার পুর্নজন্ম লাভ করে। স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক বছর পর আবারও ডুরান্টকে অনুভব করেন থমাস। তিনি বলেন ‘‘সবসময় ডুরান্ট ছিল আমার চিন্তার প্রান্তে।’’
২০১৫ সালে টেলিফোন কল করে থমাসকে অবাক করে দেয় ডুরান্ট। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ‘টমি’ শব্দটি ভেসে আসার সাথে সাথেই আত্মহারা হয়ে যান থমাস। তার এই নামটি শুধু ডুরান্টই ব্যবহার করতেন। থমাসের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘‘এটি আমার আবেগকে আলোড়িত করেছিল, দীর্ঘ সময়ের জন্য যা সুপ্ত ছিল।’’
ইন্টারনেটের কল্যাণে দেখা হয় এই যুগলের। ভাইবারের মাধ্যমে দুজনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন ডুরান্টের ছেলে। স্বামী এবং সন্তানদের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছিলেন ডুরান্ট। আবার দেখা হয় দুজনের। আলিঙ্গন করেন একে অপরকে।
৭১ বছর পর সব কিছু ছাপিয়ে মিলিত হয় যুদ্ধ দগ্ধ প্রেম। রক্ত পিপাসু শক্তিদের যে খেলা তাদের বিচ্ছিন্ন করেছিল, সে খেলা আদতে পরাজিত হয়েছে। শুধু থমাস-ডুরান্টেই নয় যুদ্ধ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে এমন জানা অজানা অগণিত প্রেমিক- প্রেমিকার। অথচ গড়তে পারেনি কিছুই।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি ৯৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন অমর প্রেম গাঁথার নায়ক নরউড থমাস।
টিএম/একেবি