সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

কেন ফিলিস্তিনপন্থী সমাবেশে বাধা দিচ্ছে ভারত? 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

কেন ফিলিস্তিপন্থী সমাবেশে বাধা দিচ্ছে ভারত? 
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (ডানে)। ছবি: এপি

ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে এমন সমাবেশ বা প্রতিবাদে বাধা দিচ্ছে ভারত। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদেশগুলোর রাজধানীসহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে বিক্ষোভ হচ্ছে। এসব প্রতিবাদ সমাবেশগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়েছে। 

কিন্তু, ভারতের ফিলিস্তিন-পন্থী অঞ্চল বলে পরিচিত কাশ্মিরে কোনো বিক্ষোভ হচ্ছে না। সেখানে মূলত কবরের নিরবতা বিরাজ করছে। কারণ, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে কোনো সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। এমনকি সেখানকার মুসলিম নেতাদের বলা হয়েছে যে তাদের ধর্মোপদেশে যেন কোনো সংঘাতের কথা উল্লেখ না করা হয়। ভারতের ওই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা এবং ধর্মীয় নেতারা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-কে এসব বিষয়ে জানিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনে করে যে এসব ফিলিস্তিন-পন্থী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ একটা সময়ে ওই বিতর্কিত অঞ্চলে নয়াদিল্লির শাসনের অবসানের দাবিতে পরিণত হতে পারে। এমন শঙ্কায় তারা এসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এছাড়া ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থন না করে, এখন ইসরায়েলপন্থী নীতি অবলম্বন করছেন। যদিও এর আগে দেশটি দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে তাদের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনা করত, কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ওই নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। 

আরও পড়ুন: হামাসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান মালয়েশিয়ার

এর আগে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংকটে ভারত একটি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল। মূলত, দেশটি উভয় পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছিল। এরপর ৭ অক্টোবর তারিখে ইসরায়েলে হামাসের অভিযানের পর ভারত এ ফিলিস্তিনি সংগঠনটির তীব্র নিন্দা করেছে। এছাড়া দেশটি ইসরায়েলের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে। একইসাথে ক্রমবর্ধমান হারে বেসামরিক মৃত্যুর কারণে তারা গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বহাল রাখার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু, তারা ইসরায়েলের কোনো নিন্দা করছে না।

অপরদিকে গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলা মধ্যে কাশ্মিরি মুসলিমদের পক্ষে চুপ থাকাটা সত্যিই বেদনাদায়ক। এ বিষয়ে মুসলিম নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুক বলেন, ‘ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিন আমাদের খুব প্রিয় একটি দেশ। সেখানে সংঘটিত অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই আওয়াজ তুলতে হবে। কিন্তু আমরা নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছি।’


বিজ্ঞাপন


তিনি জানান, ‘ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতি শুক্রবার তাকে গৃহবন্দী করা হয়েছে এবং কাশ্মিরের প্রধান শহর শ্রীনগরে এই অঞ্চলের বৃহত্তম মসজিদে শুক্রবারের নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’ 

এভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিন-পন্থী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করছে।

কাশ্মির অঞ্চলে প্রবল ভারতবিরোধী মনোভাব বিরাজমান। এখনও ভারত ও পাকিস্তান সম্পূর্ণ কাশ্মির অঞ্চলের মালিকানা দাবি করছে। এর আগে ২০১৯ সালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলের আধা-স্বায়ত্তশাসন বিলোপ করেছে। তারা এখানে যেকোনো ধরনের ভিন্নমত, নাগরিক স্বাধীনতা এবং মিডিয়ার স্বাধীনতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।

এর আগে কাশ্মিরিরা দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দৃঢ় সংহতি প্রকাশ করেছে। গাজায় সংঘটিত পূর্ববর্তী যুদ্ধের সময় প্রায়ই বড় ইসরায়েল-বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে সেখানে। এরপর এসব সমাবেশ বা প্রতিবাদে যোগ দেওয়া কাশ্মিরিরা এ অঞ্চলে ভারতীয় শাসনের অবসান চেয়েছে। এমনকি এসব ইস্যুতে সেখানে ব্যাপক সংঘাতও হয়েছে।

আরও পড়ুন: উত্তর গাজায় এক ইসরায়েলি সেনা নিহত, আহত ২

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি এবারের ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংঘাতে দ্রুত ইসরায়েলের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তিনি প্রথম বিশ্বনেতাদের মধ্যে একজন যিনি অতি দ্রুত ইসরায়েলকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। একইসাথে তিনি হামাসের আক্রমণকে "উগ্রবাদ" বলে অভিহিত করেন।

এরপর ১২ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি জারি করে যে তারা একটি সার্বভৌম, স্বাধীন এবং কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র চায়। যে দেশটি নিরাপদ এবং স্বীকৃত সীমানার মধ্যে, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিতে পাশাপাশি বসবাস করবে।

অথচ, দুই সপ্তাহ পরে ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটের সময় ভোটদানে বিরত থাকে। যদিও ওই সময় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গাজায় একটি মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল। 

ভারত মানবিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভোট না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছে, এ প্রস্তাবে ৭ অক্টোবর তারিখে হওয়া হামাসের অভিযানের নিন্দা করা হয়নি। এ কারণে তারা মানবিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভোট দেয়নি।

উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, এটা ভারতের একটি অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। কারণ, ভারত গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণকে একটি উগ্রবাদবিরোধী অভিযান হিসেবে দেখে। তারা মনে করে যে এটা করা হচ্ছে হামাসকে নির্মূল করার জন্য। এ ইসরায়েলি হামলাগুলোতে বেসামরিকদের লক্ষ্য করে আক্রমণ করা হচ্ছে না। এভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গিকে ন্যায্যতা দিয়েছে। এ কারণে ভারত মনে করে যে এই ধরনের অভিযানে মানবিক যুদ্ধবিরতি দেওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘এটা শুধু ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। আপনি যদি কোনো সাধারণ ভারতীয়কে জিজ্ঞাসা করেন, তারা বলবে উগ্রবাদ একটি সমস্যা। এখানকার মানুষ এ বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত। কারণ খুব কম দেশ এবং সমাজ আমাদের মতো উগ্রবাদের শিকার হয়েছে।’ 

এভাবেই ভারতীয় অবস্থানকে ন্যায্যতা দিয়েছেন এস জয়শঙ্কর।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, মোদির সরকার ইসরায়েলপন্থী নীতি অবলম্বন করছে, কারণ এতে ভারতে তাদের ভোট বাড়বে। 

ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন। মূলত, এসব হিন্দু জাতীয়তাবাদীরাই বিজেপির মূল ভোট ব্যাংক। তাদের খুশি করতেই মোদির সরকার ইসরায়েলপন্থী নীতি অবলম্বন করছে। এছাড়া মুসলিম-বিরোধী মনোভাবই বিজেপির উত্থানে ভূমিকা রেখেছিল।

এখন ভারতে ক্ষমতাসীন দলটি এই মাসে একাধিক রাজ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব নির্বাচন পরের বছরের জাতীয় নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নারাজ করতে চায় না।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থি বলেছেন, ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে চলছে। ভারতে বিশালাকারের মুসলিম জনসংখ্যার কারণে অন্যান্য বৈশ্বিক সংঘাতের বিপরীতে (গাজা) যুদ্ধের অভ্যন্তরীণ প্রভাব পড়তে পারে। দেশটি প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের আবাসস্থল, তারা সেখানকার বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।

সূত্র : এপি

এমইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর