সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

কেন দূরত্ব বাড়ছে তুরস্ক-ভারতের?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:০০ এএম

শেয়ার করুন:

কেন দূরত্ব বাড়ছে তুরস্ক-ভারতের?
সম্প্রতি ভারতে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেন এরদোয়ান। ছবি: ডেইলি সাবাহ

চলতি মাসের গোড়ায় দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যে বিশ্বনেতারা ভারতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও। সম্মেলনের অবকাশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর ‘দক্ষিণ এশিয়াতে তুরস্কের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার’ ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি।

দিল্লিতে এরদোয়ান ও মোদি যখন করমর্দন করে আলোকচিত্রীদের সামনে ‘পোজ’ দিচ্ছেন, তার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগেই দিল্লিতে ঘোষিত হয়েছে ‘ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ’ অর্থনৈতিক করিডর বা আইএমইসি এর রূপরেখা।


বিজ্ঞাপন


মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) ও সেই সঙ্গে আমিরাত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে সেখানে জানানো হয়েছে, নৌপথে ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে শুরু করে তারপর রেলে আমিরাত, সৌদি, জর্ডান ও ইসরায়েল হয়ে আবার সমুদ্রপথে এই করিডর কীভাবে ইউরোপের বন্দরে গিয়ে ভিড়বে।

এই করিডরের ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হয়েছিল যে দেশগুলো, তার অন্যতম হল তুরস্ক। তুরস্ক থেকে যে সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হয়ে দিল্লিতে এসেছিলেন, পরদিন তাদেরকে এরদোয়ান সাফ জানিয়ে দেন, “তুরস্ককে পাশ কাটিয়ে এরকম কোনও করিডর তৈরির চেষ্টা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না।”

আরও পড়ুন: কত বড় দেশ তুরস্ক, এর অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি কেমন?

পূর্বের এশিয়া থেকে পশ্চিমে ইউরোপের মাঝে কোনও ‘ট্র্যাফিক’ (পণ্য চলাচল) গেলে তা তুরস্কের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, আঙ্কারার এই অবস্থানের কথাও খুব স্পষ্টভাবেই সেদিন ঘোষণা করেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে কয়েকদিনের মধ্যেই এরদোয়ান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে যান এবং সেখানে বিগত কয়েক বছরের মতো আবারও কাশ্মির ইস্যুতে ভারতকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন।


বিজ্ঞাপন


ভারতও যথারীতি সেই বক্তব্যকে নস্যাৎ করে জানায়, কাশ্মির প্রশ্নে তিনি স্রেফ পাকিস্তানের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করছেন – যাকে কোনও গুরুত্ব দেওয়ারই দরকার নেই।

এরই মধ্যে দিল্লির ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকা রিপোর্ট করে, দিল্লি সফরের সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট শহরের বিখ্যাত জামা মসজিদে গিয়ে শাহী ইমামের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন– কিন্তু ভারত সরকার তার সেই অনুরোধ খারিজ করে দেয়। ফলে তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে বলে কিছুদিন আগেও যে ধারণা তৈরি হচ্ছিল তা ধূলিসাৎ হতেও সময় লাগেনি। বস্তুত এই মুহুর্তে দু’দেশের সম্পর্ক যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

পর্যবেক্ষকরা আরও বলছেন, ইসরায়েল, গ্রিস, সাইপ্রাস বা আর্মেনিয়ার মতো তুরস্কের যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক খুব খারাপ – ঠিক তাদের সঙ্গেই ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা এই সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

‘বড় কাঁটা কাশ্মির’
দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা কাশ্মির। এরদোয়ান সাম্প্রতিককালে যেভাবে কাশ্মির ইস্যু সামনে এনেছেন তেমনটা আর কেউই করেননি।

গত সাত-আট বছর ধরে তিনি কাশ্মিরে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তুলেছেন, তার সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদেও বিষয়টি বারবার উত্থাপন করেছে।

২০১৯-এ জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে এরদোয়ান ‘কাশ্মির কনফ্লিক্ট’কে সাত দশক ধরে ভুলে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও তীব্র ভাষায় দায়ী করেছিলেন।

এর মধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বেশ কিছুটা পুরনো হলেও গ্রিস, সাইপ্রাস বা আর্মেনিয়ার সঙ্গে ভারত সম্পর্ক উন্নয়ন করার ব্যাপারে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। গত মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে দেশে ফেরার পথে নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রীয় সফরে গ্রিসে গিয়েছিলেন – যেটা ছিল সে দেশে চল্লিশ বছরের মধ্যে কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর।

সেই সফরের মাত্র দিন পনেরোর মধ্যেই দিল্লিতে আইএমইসি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়, যে করিডরের ইউরোপ প্রান্তে গ্রিস গুরুত্বপূর্ণ হাব। তুরস্ককে উপেক্ষা করে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিসকে যেভাবে ওই করিডরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এরদোয়ান ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেটা তিনি মানতে পারছেন না। অন্যদিকে গ্রিস যেমন ভারতকে কাশ্মির প্রশ্নে সমর্থন করছে, তেমনি ভারতও সাইপ্রাস ইস্যুতে গ্রিসকে সমর্থন জানাচ্ছে।

আর্মেনিয়াতে ১৯১৫ সালে সংঘটিত জেনোসাইড বা গণহত্যাকে কেন্দ্র করে তুরস্কের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে – সেই আর্মেনিয়াতেও জি-টু-জি বা সরকারি পর্যায়ে করা চুক্তির আওতায় ভারত সম্প্রতি অস্ত্র রফতানির পদক্ষেপ নিয়েছে।

ইস্তাম্বুলের সিনিয়র সাংবাদিক বেকির সিটকি সিরিন মনে করেন, এই সব কারণেই ভারতের এই নতুন নতুন ‘ডিপ্লোম্যাটিক আউটরিচ’গুলোকে তুরস্ক খুব একটা ভাল নজরে দেখছে না।

তিনি বলেন, “তুরস্কের একটা সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে তাদের ভৌগোলিক অঞ্চলে ভারত নিজস্ব প্রভাব বাড়িয়ে তাদের বিরক্ত করতে চাইছে।”

অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ কবীর তানেজা অনেকটা একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলছিলেন, “হয়তো এটা ভারতের তুরস্ককে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা (মেসেজিং) যে তোমরা কাশ্মির নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আমরাও তোমাদের ঘরের পাশে গিয়ে গন্ডগোল করব।”

এরই মধ্যে আগামী বছরের গোড়ায় গ্রিস-ইসরায়েল-সাইপ্রাস ও সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত ‘থ্রি প্লাস ওয়ান’ গ্রুপিংয়ের সম্মেলনেও ভারতকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে – এই পদক্ষেপেও তুরস্ক যথারীতি খুশি নয়।

সম্পর্ক কি স্বাভাবিক করা সম্ভব?
বিগত সাড়ে নয় বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে নরেন্দ্র মোদি একটিবারের জন্যও কোনও দ্বিপাক্ষিক সফরে তুরস্কতে যাননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি একবারই তুরস্কে গিয়েছিলেন – সেটা ২০১৫তে বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম জি- ২০ এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে।

অন্য দিকে এরদোয়ান এই সময়কালে মাত্র একবারই দ্বিপাক্ষিক সফরে ভারতে এসেছেন, কিন্তু ২০১৭তে ওই সফরের ঠিক আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি কাশ্মির প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেওয়ায় সেই সফরও একরকম ভেস্তে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন: নতুন যুগে সৌদি-তুরস্ক সম্পর্ক

কাশ্মির প্রশ্নে ভারতের ঘোষিত অবস্থান হল, ১৯৭২ এর সিমলা চুক্তি অনুসারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিকভাবেই এর মীমাংসা হতে হবে – অন্য কোনও তৃতীয় পক্ষ এর মধ্যে ঢুকতে পারবে না। এরদোয়ান সেই বিরোধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে সফরের আগেই ভারতকে চটিয়ে দিয়েছিলেন – যে সম্পর্ক আজ পর্যন্ত স্বাভাবিক তো হয়ইনি, বরং দু’পক্ষের মধ্যে তিক্ততা ক্রমশ বেড়েছে।

তুরস্কের সাংবাদিক বেকির সিটকি সিরিন বলছেন, কাশ্মিরের মতো সংবেদনশীল ইস্যুতেও একটা মাঝামাঝি রাস্তা নেওয়ার অবকাশ আছে বলে এরদোয়ান এখনও বিশ্বাস করেন।

সিরিনের কথায়, “তুরস্ক মনে করে ভারত ও পাকিস্তান যা বলছে সে দুটো রাস্তার বাইরেও কাশ্মির নিয়ে একটা মধ্যপন্থী সমাধান সম্ভব। এটা এমন একটা পথ, যেটাতে ভারতীয়, পাকিস্তানি বা কাশ্মিরিরা কেউই ভিক্টিম হবেন না বলে এরদোয়ানের বিশ্বাস। এই আইডিয়াটা তিনি ভারতকে বোঝাতে পারলে দু’দেশের সম্পর্কের উন্নতি হতে বাধ্য।”

তবে কাশ্মির প্রশ্নে ভারত তাদের অবস্থান নমনীয় করার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত দেয়নি – বরং বছর চারেক আগে ওই অঞ্চলের বিশেষ স্বীকৃতি লোপ করার ভারত সরকার সেখানে পরিস্থিতি আরও শক্ত হাতে দমন করতে শুরু করেছে। এছাড়া ‘মধ্যস্থ’ হিসেবে এরদোয়ানের মতো পাকিস্তানের মিত্রকে ভারত যে কিছুতেই মেনে নেবে না, তাতেও কোনও সংশয় নেই।

ফলে তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক অদূর ভবিষ্যতে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে পারে, দিল্লিতে অন্তত পর্যবেক্ষকরা তার কোনও লক্ষণই দেখছেন না।

সূত্র: বিবিসি

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর