ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মরক্কোর এক গ্রামের প্রায় সবাই মৃত অথবা নিখোঁজ বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। এ বিষয়ে দেশটির অ্যাটলাস পর্বতমালার তাফেঘাঘতে গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, “এই গ্রামের সব মানুষ হয় হাসপাতালে, আর না হয় মৃত।”
সেখানে ইট ও পাথরের তৈরি গ্রামের পুরনো ধাঁচের বাড়িগুলো কোনোভাবেই এই প্রবল মাত্রার ভূমিকম্প সামাল দেওয়ার মতো ছিল না। গ্রামের ২০০ জন বাসিন্দার মধ্যে ৯০ জনের মৃত্যুর খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও অনেকেই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা হাসান সাংবাদিকদের বলছিলেন, “তারা (নিখোঁজরা) সরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। তাদের হাতে নিজেদের বাঁচানোর সময়ও ছিল না ।”
তিনি বলছিলেন যে তার চাচা এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাকে সেখান থেকে বের করার কোনো সম্ভাবনাও নেই।
গ্রামে কারো কাছে এই মাত্রার ধ্বংসস্তূপ খোড়ার যন্ত্রপাতি নেই। আর তিন দিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞরাও এসে পৌঁছায়নি।
“আল্লাহ আমাদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছেন এবং আমরা সবকিছুর জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এখন আমাদের সরকারের সহায়তা দরকার। তারা মানুষকে সাহায্য করার বিষয়ে অনেক দেরি করে ফেলেছে”, বলছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: মরক্কোতে ভূমিকম্প: নিহত বেড়ে আড়াই হাজার
হাসান বলছিলেন যে মরক্কোর কর্তৃপক্ষের উচিৎ সব ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণ করা। কিন্তু তিনি সন্দেহ পোষণ করেন যে নিজেদের অহঙ্কারের কারণে হয়তো তারা সেই সহায়তা নেবে না।
গ্রামের আরেক প্রান্তে গিয়ে সাংবাদিকরা দেখতে পায় যে বেশ কিছু মানুষ একজন ব্যক্তিকে সমবেদনা জানাচ্ছেন।
এরপর তারা জানতে পারেন যে ওই ব্যক্তির নাম আব্দো রহমান। ভূমিকম্পে তার তিন ছেলে ও স্ত্রী মারা গেছে।
বালি-পাথরের একটি স্তূপের দিকে নির্দেশ করে তিনি বলছিলেন, “আমাদের বাড়ি ছিল ওখানে।” এক সময় তার বাড়ি থাকলেও এখন সেখানে কোনো বাড়ির চিহ্নও নেই।
“ওই যে দেখুন সাদা কম্বল ও কিছু আসবাব এখনও দেখা যাচ্ছে। বাকি সব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।”
ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পর আব্দো রহমান তিন কিলোমিটার দৌড়ে তার বাড়ির দিকে আসেন। ভূমিকম্পের সময় তিনি যেই পেট্রোল পাম্পে কাজ করেন, সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন।
তার বাড়ির কাছে এসে চিৎকার করে তার ছেলেদের নাম ধরে ডাকাডাকি করেন রহমান। তার মতো আরও কয়েকজনও তখন তাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজছিলেন।
“গতকাল আমরা তাদের কবর দিয়েছি”, বলছিলেন আব্দো রহমান।
“আমরা যখন তাদের লাশ খুঁজে পাই, তখন তারা সবাই একসঙ্গে গুটিশুটি মেরেছিল। তিন ছেলেই ঘুমাচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেই তারা মারা যায়।”
আরেকটু সামনে, গ্রামের সঙ্গে লাগোয়া পাহাড়ি রাস্তার মোড়ে, একটি বড় তাঁবুতে বেশ কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে অপেক্ষা করছিল।
সবদিক থেকেই শোনা যাচ্ছিল অবিরাম কান্নার আওয়াজ।
কিছুক্ষণ আগেই ১০ বছর বয়সী শিশু খালিফার মরদেহ টেনে বের করা হয়েছে পাথরের স্তূপের নিচ থেকে। সেই লাশকে ঘিরে চলছিল আহাজারি।
মরক্কোর অ্যাটলাস পর্বতমালা অঞ্চলের একের পর এক গ্রামে ঠিক এই চিত্রই এখন দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে রাশিয়ায় কিম জং উন
ঐতিহ্যবাহী এই সম্প্রদায়গুলো সাধারণত আধুনিক পৃথিবী থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্নই থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বাইরের সাহায্য প্রয়োজন তাদের।
ভূমিকম্পের সবশেষ পরিস্থিতি কী?
অ্যাটলাস পর্বতমালার মতো মরক্কোর আরও অনেক অঞ্চলেই জরুরি সেবা পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশটির কর্তৃপক্ষকে।
বিভিন্ন এলাকায় গ্রামবাসী হাত দিয়ে বা তাদের কাছে থাকা বেলচা, শাবল দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধার করছেন।
আবার কিছুক্ষণ পর ওই বেলচা আর শাবল দিয়েই মরদেহের জন্য কবরও খুঁড়তে হচ্ছে তাদের।
বিবিসিকে এরকম একটি গ্রামের একজন বাসিন্দা বলছিলেন, “মানুষের কাছে আর কিছুই বাকি নেই। গ্রামে কোনো খাবার নেই, শিশুরা পানির পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছে।”
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দুই হাজার ১২২ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজারের মতো মানুষ।
মারাকেশ থেকে ৫৫ কিলোমিটারের দক্ষিণের পাহাড়ি শহর আমিজমিজের প্রায় পুরোটাই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
স্থানীয় হাসপাতাল ভবনটিও এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে সেটির ভেতরে কাউকে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের সামনের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে সেই তাঁবুর ভেতরেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মানুষকে।
শহরের কেন্দ্রে ঢালাওভাবে পাটি বিছিয়ে টানা তিন দিন রাত কাটিয়েছে শত শত মানুষ। আবারও ভূমিকম্প হতে পারে, এমন আশঙ্কায় তিন রাত ধরে ঘরে থাকছেন না তারা।
এই শহরের মতো আরও অনেক অঞ্চলেই প্রতিদিনই অগণিত কবর খুঁড়তে হচ্ছে গোরখোদকদের।
ভূমিকম্পের পর মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ শনিবার দেশটিতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনী যেন উদ্ধারকাজে এবং জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে, সেরকম নির্দেশও দেন তিনি।
কিন্তু এখনও দেশটির বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে অ্যাটলাস পর্বতমালা অঞ্চলের অনেক গ্রামে, জরুরি সেবা ও প্রয়োজনীয় সহায়তার অভাবে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছেন সাধারণ মানুষ।
সূত্র : বিবিসি
এমইউ