ইউক্রেন যুদ্ধ একটি জটিল পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি আগামীতে কীভাবে এগোবে এবং ইউরোপের নিরাপত্তাকে কীভাবে প্রভাবতি করতে পারে সে বিষয়টি যুদ্ধ শুরুর দেড় বছরেও অস্পষ্ট। দুই মাস আগে ইউক্রেনের শুরু করা পাল্টা আক্রমণের গতি স্তিমিত হয়ে এসেছে। রাশিয়াও পা ফেলছে আগের চেয়েও সতর্কভাবে।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, রাশিয়ার আক্রমণের ১৮ মাসে ইউক্রেনীয়রা বেশিরভাগই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে রয়েছে। তারা মস্কোর বাহিনীকে আরও অঞ্চল দখল করতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু এই গ্রীষ্মে ইউক্রেন বিলিয়ন পাউন্ড পশ্চিমা সামরিক সরঞ্জামের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়েছে। তারা রাশিয়ানদের পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের দখল করা ভূমি থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করছে।
দুই মাসের এই পাল্টা আক্রমনে ইউক্রেন কি কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে? যুদ্ধের ভিডিও ও তথ্য বিশ্লেষণ করে বিবিসি জানিয়েছে যে, পাল্টা আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে দুই মাসে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। রাশিয়া এখনও ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দখল করে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে পূর্বের দোনেৎস্ক শহর এবং মারিউপোল।
প্রকৃতপক্ষে, ২০২২ সালের নভেম্বরের পর থেকে নয় মাসে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। ওই সময়ে ইউক্রেন সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল। তারা রাশিয়ার দখল করা খেরসন ও উত্তর-পূর্বের বিশাল এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করেছিল। তবে বড় সাফল্য না পেলেও সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত যুদ্ধে ইউক্রেনের জন্য খুব একটা খারাপ খবরও আসেনি। তারা জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় সেনারা সম্প্রতি দোনেৎস্ক অঞ্চলের স্টারোমাইয়রক্স গ্রাম পুনরুদ্ধার করেছে।
ভিডিও বিশ্লেষণ করে বিবিসি জানিয়েছে, বাখমুতের আশেপাশে যেখানে তীব্র লড়াই হয়েছে, সেখান থেকে ইউক্রেন গ্রীষ্মের শুরুতে হারিয়ে যাওয়া কিছু ছোট এলাকা ফিরে পেয়েছে। এছাড়া দক্ষিণের জাপোরিঝিয়া অঞ্চলেও সামান্য অগ্রগতি হয়েছে ইউক্রেনের।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজভ সাগরে রুশ-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের সাফল্য রাশিয়ার সরবরাহ রুটকে সংকটে ফেলবে। এছাড়া রাশিয়া-অধিভুক্ত ক্রিমিয়া এবং আরও পশ্চিমে তাদের বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।
ইউক্রেনের অগ্রগতি এত ধীর কেন?
বিবিসি বলছে, স্বাধীন বিশ্লেষণ অনুসারে- দুই মাসে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা এই অঞ্চলের ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) ফ্রন্ট বরাবর দুটি এলাকায় প্রায় ১০ মাইল (১৬ কিমি) অগ্রসর হয়েছে। পাল্টা আক্রমণে ইউক্রেনের অগ্রগতি হচ্ছে, কিন্তু এটি ইউক্রেন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা যতটা আশা করেছিল তার চেয়ে অনেক ধীর।
আরও পড়ুন: পশ্চিমাদের অকেজো অস্ত্রের ‘ভাগাড়’ ইউক্রেন!
ইউক্রেনীয় বাহিনী পশ্চিমা সরবরাহকৃত সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ ব্যবহার করে তিনটি ফ্রন্টে আক্রমণ করছে। তারা পুরো ৭০০ মাইল (১,১২৫ কিলোমিটার) ফ্রন্ট লাইন বরাবর দুর্বল জায়গাগুলো অনুসন্ধান করে এসব পাল্টা আক্রমণ করছে।
খবরে বিবিসি জানিয়েছে, রাশিয়ান বাহিনী আগে থেকেই ইউক্রেনকে ঠেকাতে বিস্তৃত দুর্গ তৈরি করেছে। তারা কয়েক মাস ব্যয় করে তিন স্তরের পরিখা, বাঙ্কার ও কংক্রিট পিরামিড ট্যাঙ্ক-ফাঁদ তৈরি করেছে। এছাড়া হাজার হাজার ল্যান্ডমাইন পুতে রেখেছে তারা। এটি ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রায় বড় বাধা।
কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মেরিনা মিরন বলেন, ইউক্রেনকে ক্রিমিয়া ফিরিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাসহ দক্ষিণে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করা অকল্পনীয়। তার কথায়, 'আমি মনে করি না যে এটি শিগগিরই ঘটবে'।
বিবিসি বলছে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী আক্রমণের প্রথম ১২ মাসে করা কিছু ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের পরবর্তী প্রতিরক্ষা আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া প্রচুর অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন ব্যবহার করছে। পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত মাইন-ক্লিয়ারিং যানবাহন সাধারণত এসব মাইনের একটি আঘাত সহ্য করতে পারে, তবে দুটি নয়। তাই রাশিয়ানরাও তাদের কৌশল সেভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এছাড়া রাশিয়ার সামরিক বাহিনী বিমান শক্তিরও সুবিধা নিচ্ছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে। বর্তমান সময়ের যুদ্ধে বিমান শক্তিই সবচেয়ে এগিয়ে।
পরবর্তীতে কী হবে?
রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করার পর ইউক্রেন ধীরে ধীরে তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। পশ্চিমাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র পেয়েছে। শত শত সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বেশ কয়েকটি মিত্র দেশ। রাশিয়ার চেয়ে কিছুক্ষেত্রে ভালো সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত হয়েছে তারা।
ইউক্রেনের এখন রাশিয়ান বাহিনীর গভীরে ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা শেল নিক্ষেপ করার ক্ষমতা রয়েছে। ইউক্রেন এসব অস্ত্রের সাহায্যে রাশিয়ার জ্বালানী ডিপো, গোলাবারুদ হাব এবং কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলোতে আঘাত করতে পারে। এসব হামলা চালানো হলে দুর্বল হয়ে যেতে পারে রাশিয়া। ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ক্লাস্টার বোমাও ব্যবহার করছে।
তবে জেনস ডিফেন্সের একজন বিশ্লেষক জিয়ান লুকা ক্যাপোভিন বলেছেন, ক্লাস্টার বোমা ইউক্রেনকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এটি খেলা পরিবর্তনকারী হবে না। রাশিয়ার নিজস্ব ক্লাস্টার বোমা রয়েছে। তারা সেটি ব্যবহার করছে। তবে শেষ পর্যন্ত, সময় ইউক্রেনের পক্ষে নয়।
তিনি বলেন, শিগগিরই বর্ষাকাল এসে যাবে, কাঁচা রাস্তাগুলো কাদায় পরিণত হবে এবং ইউক্রেনের অগ্রগতি আরও কঠিন করে তুলবে।
আরও পড়ুন: ইউক্রেন যুদ্ধ: গোলাপের সুবাস হারিয়ে যাচ্ছে লাশের গন্ধে
তিনি মনে করেন, যদি ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি দেখাতে না পারে এবং একটি সিদ্ধান্তে আসতে না পারে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের উচ্চ পর্যায়ের সাহায্য অব্যাহত রাখবে কি না তা নিশ্চিত নয়। কিয়েভের জন্য ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে। অপরদিকে রাশিয়াও নতুন এলাকা দখল করতে সক্ষম হবে না।
একে