বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থলবেষ্টিত দেশ মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তান। পরিবহন খাত দেশটির টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। দেশটির সাধারণ মানুষের জন্যও পরিবহন বা যোগাযোগ খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজাখ শব্দটি তুর্কি। এর অর্থ বিস্ময়। সামগ্রিকভাবে যোগাযোগ বা পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতির মাধ্যমে বিস্ময় সৃষ্টি করছে দেশটি।
প্রাকৃতিকভাবে সম্পদ সমৃদ্ধ অর্থনীতি হিসাবে টিকে থাকতে কাজাখস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি অন্যতম একটি উপায়। এক স্থান থেকে অন্যস্থানে দ্রুত স্থানান্তর এবং যোগাযোগ বিশ্ব অর্থনীতিতে টিকে থাকতেই এটির প্রয়োজন। সহজভাবে বললে একটি দেশের ভালো পরিবহন বা যোগাযোগ ব্যবস্থার অর্থ হলো- সস্তা রফতানি খরচ এবং এর সাথে বিশ্বের আরও অনেক ধরনের ব্যবসা যুক্ত করা।
বিজ্ঞাপন
বিশাল ভূমির দেশটি ইউরোপ ও এশিয়ার সেতুবন্ধনকারী একটি কৌশলগত অবস্থান দখল করে আছে। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাণিজ্যকে কাছাকাছি আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে দেশটি। অন্যদিকে ইতিহাস, একই ভাষা এবং সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক বন্ধনের জন্য মধ্য এশিয়ার অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুও বলা হয়ে থাকে কাজাখস্তানকে।

কাজাখস্তানের পরিবহণ খাত ২০২২ সালের হিসাবে জিডিপির প্রায় ১১% ছিল। দেশটিতে যা সম্ভাবনা আছে সেটি কার্যকর করা গেলে এই মাত্রা আরও অনেক বাড়বে এবং বহিরাগত বিনিয়োগে গুরুত্ব বাড়বে। এই লক্ষ্যে, কাজাখস্তান বিচারিক সংস্কার এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল খোলার মাধ্যমে তার বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে প্রস্তুত।
কাজাখস্তানের সবচেয়ে বিশিষ্ট পরিবহন খাত হলো রেল। এটি দেশের অর্ধেকের বেশি মালামাল পরিবহন করে। তারপরও এই ব্যবস্থা দেশটিতে অপ্রতুল। পশ্চিম ইউরোপের আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও কাজাখস্তানে মাত্র ১৬ হাজার কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মালবাহী রেল দুই প্রতিবেশী উজবেকিস্তান (৪৫%) এবং কিরগিজস্তান (২০%) এ যাতায়াত করে। তবে কৌশলগত অবস্থানের কারণে কাজাখস্তান নতুন সম্ভাবনার সন্ধান করছে। দেশটিতে অসংখ্য রেল সম্প্রসারণ এবং আপগ্রেড প্রকল্প চলছে। এরকম একটি প্রকল্প দোস্তিক (চীনের সীমান্তের কাছে) থেকে ময়ন্তি পর্যন্ত লাইনের ক্ষমতা পাঁচগুণ বাড়িয়ে দেবে। পাশাপাশি ট্রানজিট সংযোগ এবং পণ্য রফতানিতে সহায়তা করার পাশাপাশি জ্বালানি ও যোগাযোগ সুবিধাও তৈরি করা হবে।

কাজাখস্তান শুধু স্থলপথে তার ট্রানজিট সংযোগ উন্নত করতে চাইছে না। কাস্পিয়ান সাগরের সীমানা (যা বিশ্বের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ জলাশয়) থেকে এটি ইরান, জর্জিয়া এবং আজারবাইজানসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহন করতে পারে।
দেশটির দুটি বন্দর আকতাউ এবং কুরিক এর পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ নিয়ে আবুধাবি পোর্টস গ্রুপ কাজমুনাইগ্যাসের সাথে একটি জাতীয় সামুদ্রিক নৌবহর এবং উপকূলীয় অবকাঠামো বিকাশের জন্য ২০২৩ সালের মে মাসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এয়ার ফ্রন্টে কাজাখস্তান ২০২০ সালে তুর্কিস্তানে একটি নতুন বিমানবন্দর তৈরি করেছে, আলমাটি বিমানবন্দরকে প্রসারিত করছে এবং এয়ার আস্তানার দুটি মালবাহী বিমান কিনতে যাচ্ছে। এর উপরে, কাজাখস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি ওপেন স্কাই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং অনুমোদন করেছে যার অর্থ শিগগিরই অনিয়ন্ত্রিত ফ্রিকোয়েন্সি, গন্তব্য এবং এয়ারলাইন্স সহ সরাসরি যাত্রী ফ্লাইট হতে পারে।

তবে যাত্রীদের পাশাপাশি আলমাটি একটি আঞ্চলিক কার্গো হাব হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে। মধ্য এশিয়ার ব্যস্ততম বিমানবন্দর হিসাবে এটি ইতিমধ্যে ২০১৯ সালে ৬৯ হাজার টন কার্গোর রেকর্ড করেছে।
কাজাখস্তান আন্তঃআঞ্চলিক ব্যবধান মেটানোর জন্য একা কাজ করছে না। এই ধরনের একটি সমবায় প্রকল্প হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। এর নেতৃত্বে রয়েছে চীন। এর অংশ হিসাবে কাজাখস্তানের জন্য ৩৫ বিলিয়ন মূল্যের ৫১টি মেগা প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। চীন থেকে ইউরোপে স্থল পরিবহনের ৭০ শতাংশ অংশ রয়েছে কাজাখাস্তানে।
জরিপে দেখা গেছে, এখন চীন থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনের মাত্র ১ শতাংশ যায় স্থলপথে। এছাড়া সমুদ্র পথে এই পথ পাড়ি দিতে প্রায় ১০০ দিন সময় লাগে। সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হলে চীন থেকে স্থলপথে পণ্য পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র দশ দিন। এই রুট কাজাখস্তানের পাশাপাশি এই এলাকায় নতুন সুযোগ উন্মোচন করতে পারে। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যাপক লাভবান হবে কাজাখস্তান।

আরেকটি উদাহরণ এসেছে ট্রান্স-ক্যাস্পিয়ান ইস্ট-ওয়েস্ট মিডল করিডোর থেকে। জর্জিয়া, আজারবাইজান, তুরস্ক এবং কাজাখস্তানের মধ্যে গত বছর স্বাক্ষরিত এই ঘোষণাটি ট্রানজিট লিঙ্কগুলোকে শক্তিশালী করার এবং এর সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলার একটি রূপরেখা দেয়। এছাড়া কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের সীমান্তে একটি ট্রানজিট হাব হচ্ছে, যেখানে প্রতিদিন দুই দেশের মধ্যে ৫ হাজার ট্রাক পরিচালনা করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত বিনিয়োগে এটি গড়ে উঠছে।
প্রায়শই আমরা পরিবহন পরিকাঠামো এবং সরবরাহের পরিমাণ সম্পর্কে খুব বেশি চিন্তা করি না, তবে এই খাতগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। টেবিলে খাবার রাখা থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক অংশীদার, বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে দেখা করা পর্যন্ত সবকিছুই নির্ভর করে পরিবহন বা যোগাযোগ খাতের ওপর।
সরকারী সমর্থন, আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতা এবং বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে কাজাখস্তান সঠিক পথে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও এখনও প্রচুর চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা বাকি আছে।
একনজরে কাজাখস্তান
কাজাখস্তান মধ্য এশিয়ার একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ২.৭ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটি এটি বিশ্বের নবম বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। মুসলিম প্রধান দেশটির উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে চীন, দক্ষিণে কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান এবং পশ্চিমে ক্যাস্পিয়ান সাগর ও রাশিয়া। কাজাখস্তান প্রায় সম্পূর্ণভাবে এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত। তবে দেশটির কিয়দংশ উরাল নদীর পশ্চিমে ইউরোপ মহাদেশে পড়েছে। দেশের উত্তর অংশে অবস্থিত আস্তানা (পূর্বের নাম) বা নুর-সুলতান (বর্তমান নাম) দেশটির রাজধানী।

কাজাখ ভাষা কাজাখস্তানের সরকারি ভাষা। কাজাখ নামের তুর্কীয় জাতি এখানকার প্রধান জনগোষ্ঠী। ১৮৭০-১৮৭৬ সালের মধ্যে রাশিয়া কাজাখ দখল নেয়। ১৯২২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত কাজাখস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ১৯৯১ সালে এটি স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বিদ্যমান। ১৯৯৫ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যাতে রাষ্ট্রপতিকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়।
কাজাখস্তানের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ মুসলিম। বাকি ৩০ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ কাজাখ। ৩০ ভাগ রুশ। বাকি ১০ ভাগ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির।
কাজাখস্তানের মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম ও শক্তিশালী অর্থনীতি রয়েছে। কাজাখস্তানই ছিল প্রথম সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র যে তার সমস্ত ঋণ বিশ্বকে পরিশোধ করেছিলো মুদ্রা তহবিল ও তফসিলের ৭ বছর আগে। কাজাখস্তানে জিডিপি ১৯৭.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু জিডিপি ১০,৩৭৩ মার্কিন ডলার (২০২১)।
সূত্র: বিবিসি ও উইকিপিডিয়া
একে
কাজাখস্তান/কাজাকিস্তানের ধর্ম, কাজাখস্তানে মুসলিম, কাজাখস্তান ভাষা, কাজাখস্তানের নতুন রাজধানীর নাম কি, কাজাখস্তানের অর্থনীতি, কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট, কাজাখস্তান বাংলাদেশ সম্পর্ক, কাজাখস্তান ভিসা, কাজাখস্তান কি মুসলিম দেশ, কাজাকিস্তানের আয়তন কত বর্গ কিলোমিটার, কাজাখস্তান কি সার্বভৌম দেশ।

