জীবন যখন অচলাবস্থায়, তখন শিশুরা কীভাবে বাড়ির ধারণা সম্পর্কে জানতে পারে? গ্রিসের এথেন্সের পাশে শিস্তো শরণার্থী শিবিরে শিশুদের কাছেই সেটা জানতে চাওয়া হয়েছিল। শিস্তো শরণার্থী শিবিরটি এথেন্সের উপকণ্ঠে শহরের কেন্দ্র থেকে গাড়িতে আধা ঘন্টা দূরত্বে একটি অনুর্বর ভূমিতে অবস্থিত।
ভোরেও তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এত গরমের মধ্যেও পাঁচ বছর বয়সি এক শিশু খালি পায়ে নুড়ি বিছানো পথে ছুটোছুটি করছিল দমকল বাহিনীর একটি মহড়া দেখার জন্য।
বিজ্ঞাপন
শিস্তোতে বর্তমানে ১৭ বছরের কম বয়সি ১৯৩টি শিশু রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই সিরিয়া, আফগানিস্তান, সোমালিয়া এবং ইরাকের। এখানে এখন আর কোনো অভিভাবকবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক নেই। আগে গ্রিক শরণার্থী শিবিরগুলোতে শিশুদের জন্য একটি ‘নিরাপদ জোন’ ছিল। কিন্তু এখন অভিভাবকবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের আলাদা ক্যাম্পে রাখা হয়।
‘আমরা তিন দিন রাস্তায় ছিলাম’
১১ বছর বয়সি আয়হাম আলবাহশ তার আট বছর বয়সি বোন লিনকে নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিস্তোতে সাত মাস ধরে বসবাস করছে। ইন্টিগ্রেশন বা সমাজে একীভূত হওয়ার ব্যবস্থার অংশ হিসাবে আজ আয়হাম একজন দোভাষীর মাধ্যমে এবং ক্যাম্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে গল্প করছে। ক্যাম্পের দেয়ালে রঙিন ছবি এবং হস্তশিল্প শোভা পাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
আয়হামের পরিবার সিরিয়া থেকে তুরস্কে পালিয়ে এসেছিল। সেখানে ভূমধ্যসাগর উপকূলের মেরসিন শহরে তারা আট বছর বসবাস করেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাদের নিয়ে তাদের বাবা-মা গ্রিক দ্বীপ কোস এবং এক মাস পরে শিস্তোতে পৌঁছান।
আয়হাম বলে, ‘আমার মনে আছে, আমরা তিন দিন রাস্তায় হাঁটছিলাম’।
গ্রিসে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অন্য কোনো কিছু অবশ্য তার মনে নেই।
আশ্রয়ের অপেক্ষায়
আয়হামের ৩৪ বছর বয়সি মা আলা আলহাতাব বলেন, ‘তুরস্কে আমাদের অভিজ্ঞতা ভয়ানক ছিল। আপনার সন্তান যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে জানায় যে তারা সহিংসতার শিকার হয়েছে, তখন সেটা ভয়াবহ। এটা নিরাপদ দেশ ছিল না।’
গ্রিসে তিনি নিরাপদ বোধ করছেন। শিস্তোতে তার পরিবারের সদস্যরা ভালো আচরণ পাচ্ছে বলেও জানান তিনি। কিন্তু ভবিষ্যত নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। আশ্রয়ের জন্য তার পরিবারের আবেদন দুইবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আলহাতাব জানান, আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা সিরিয়ায় ফিরতে চান না।
আরও পড়ুন: জার্মান নাগরিকত্ব পেল ২ লাখেরও বেশি বিদেশি
তিনি বলেন, ‘আমি আমার সন্তানদের জন্য সেরাটা চাই। এই মুহূর্তে আশাই একমাত্র পথ।’
শিস্তোর শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে জেনেছে যে ক্যানাডা, ব্রিটেন বা জার্মানির মতো দেশে যাওয়ার আগে গ্রিসে তারা থেমেছে। তবে এই থাকাটা কতদিনের, সেটা তারা জানে না।
‘নিজের বাড়ির’ সন্ধান
শিস্তোতে প্রতিটি পরিবার তাদের নিজেদের একটি কন্টেইনারে বাস করে। দুইটি আলাদা বেডরুমে একটি একক এবং একটি দোতলা বিছানা রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ইউনিটে একটি বাথরুম এবং একটি রান্নাঘরে চুলা ও ফ্রিজও রয়েছে। সৌর প্যানেল এবং বৈদ্যুতিক বয়লারের মাধ্যমে গরম জল সরবরাহ করা হয়। কন্টেইনারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও রয়েছে। একক-পারিবারিক ইউনিট ছাড়াও, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি বিশেষ ভবন রয়েছে।
গ্রীষ্মে স্কুল ছুটি থাকে। প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে তারা বেশিরভাগ সময়ই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসস্থানেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। তাপ ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে উঠলে বিকেলে বা সন্ধ্যায় বাইরে খেলার মাঠ এবং ছোট ফুটবল মাঠে তাদের দেখা মিলে।
আয়হাম এবং লিনের জন্য ক্যাম্পের বাইরে নানা আয়োজন বড় আনন্দের ব্যাপার। শরণার্থী সপ্তাহে আলা আলহাতাব তার দুই সন্তানকে নিয়ে এথেন্সে ঘুরতে গিয়েছিলেন। অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মিলে তারাও কার্ডবোর্ডের একটি ঘর তৈরি করেছিল। সেখানে বাসা এবং বাড়ির মধ্যে তফাতও তাদের বোঝানো হয়েছিল।
আলহাতাব বলেন, ‘সন্তানেরা প্রায়ই প্রশ্ন করে আমরা কবে আমাদের নিজের বাড়িতে যাব। আমার জন্য এটাই সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন।’
ক্যাম্পের বাইরে জীবনের জন্য প্রস্তুতি
এখানকার বেশিরভাগ শিশুই গ্রিক স্কুলে যায় এবং এরইমধ্যে গ্রিক ভাষায় কথাও বলতে পারে। অনেকে ইংরেজিতেও কথা বলে। কেউ কেউ অবশ্য একেবারেই স্কুলে যায় না।
২০২০ সাল থেকে শিস্তো ক্যাম্পের পরিচালক টমাস পাপাকোনস্টান্টিনো বলেন, ‘আমরা এই শিশু এবং তাদের বাবা-মায়েদের এটি করতে (স্কুলে যাওয়া) বাধ্য করতে পারি না এবং তা চাইও না।’
শরণার্থীদের শুধু আবাসন এবং চিকিৎসা সেবা দেয়াই নয়, শিবিরে জীবনকে ক্রমশ আরো উন্নত করার পরিকল্পনা তার। পাপাকোনস্টান্টিনো এবং তার কর্মীরা শিশুদের বিভিন্ন তথ্য জানানো এবং বোঝানোকেও বিশেষ গুরুত্ব দেন। এজন্য শিস্তোর বাইরেও নিয়মিত খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভ্রমণের আয়োজন করে তার দল।
সম্প্রতি আয়হাম এবং লিন ঐতিহাসিক প্যানঅ্যাথেনাইক স্টেডিয়ামে ইউয়েফা কনফারেন্স লিগের ফাইনাল এবং ২০২৪ প্যারিসে অলিম্পিক গেমসের আগে অলিম্পিকের শিখা প্রজ্বলন অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলো।
গণমাধ্যমের একজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে আয়হাম তার ঘর থেকে একটি ভলিবল নিয়ে আসে এবং ইউয়েফা নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বেশ আগ্রহ নিয়ে বর্ণনা করে। আয়হাম এবং তার বোন লিনসহ শিস্তোর ১২ জন শিশুকে গ্রিক দল অলিম্পিয়াকোসের খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাঠে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ১৩ বছর বয়সি হুসেইনকে খেলোয়াড়দের হাতে বল তুলে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
শিস্তোর কর্মীদের একজন গণমাধ্যমকে জানান, ‘এই শিশুরা খেলার পর এক সপ্তাহ তাদের শার্ট (জার্সি) খুলতে চায়নি।’
আয়হাম গর্ব নিয়ে জানায়, ‘যে খেলোয়াড় গোল করেছে, আমি তার সঙ্গে মাঠে যেতে দেওয়া হয়েছিল।’
কিন্তু বড় হয়ে ফুটবলার নয়, বরং ডাক্তার বা পাইলট হতে চায় আয়হাম। লিনও তার ভাইয়ের মতো খেলাধুলা পছন্দ করে, কিন্তু তারও স্বপ্ন বড় হয়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার।
তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভেলে ও ইনফো-মাইগ্রেন্টস
এজেড