মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ঢাকা

অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠাঁই দিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পোল্যান্ড

অভিবাসন ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ মে ২০২৪, ১১:৫৫ এএম

শেয়ার করুন:

poland

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে সিরীয়, আফগান এবং আফ্রিকান আশ্রয়প্রার্থীদের স্বাগত জানানো নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল পোলিশ কর্তৃপক্ষ। পর্যবেক্ষকের মতে, দেশটির সাবেক রক্ষণশীল সরকার ২০২১ সালে অভিবাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। খবর ইনফোমাইগ্রেন্টসের।

উত্তর-পূর্ব পোল্যান্ডের ওয়াজনোওকা গ্রামের রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু কাঠের ঘর। গ্রামের বাগানগুলোতে হলুদ ও লাল টিউলিপ ফুল। রাস্তার এক দিকে একটি ছোট জঞ্জাল কেবিন সদৃশ যেখানে বাস এসে দাঁড়ায়। যদিও এই বাসটি গ্রামের মধ্য দিয়ে দৈনিক মাত্র এক বা দুইবার আসা যাওয়া করে। 


বিজ্ঞাপন


এই গ্রামে আশ্রয়প্রার্থীদের সহায়তা করে স্থানীয় এনজিও পোদলাজি ভলান্টারি হিউম্যানিটারিয়ান ইমার্জেন্সি সার্ভিস (পিওপিএইচ)। গ্রামে থাকা ৪০ বাসিন্দার মধ্যে ২০ জন শনিবার বিকেলে এসেছেন এনজিওটির কেন্দ্রে। বেলারুশ সীমান্ত থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওয়াজনোওকা গ্রামে প্রায় প্রতিদিনই অভিবাসীদের ছোট দল পার হয়ে যায়। ২০২১ সালের গ্রীষ্মের পর থেকে হাজার হাজার অভিবাসী রাশিয়া এবং বেলারুশ পার হয়ে এই অভিবাসন রুটটিতে আসছে। 

তাদের অধিকাংশই প্রথমবারের মতো সীমান্তবর্তী পোডলাজি অঞ্চল হয়ে পোল্যান্ডের মাটিতে পা রাখেন। ওয়াজনোওকা পোডলাজি অঞ্চলের অন্তর্গত একটি গ্রাম।

poland 

গ্রামের এক বাসিন্দা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান, দুই বছর ধরে আমি সীমান্তরক্ষীদের আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে দেখছি। আমার পোষা কুকুরগুলো প্রায়ই তাদের দেখে ঘেউ ঘেউ করে। আমি এখানে আর নিরাপদ বোধ করিনা। 


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও যোগ করেন, অভিবাসীদের উপস্থিতির কারণে নয়, মূলত পুলিশ এবং সৈন্যদের গাড়ির উপস্থিতির কারণেই মূলত নিরাপদ বোধ করিনা। আমি অভিবাসীদের পরিস্থিতি বুঝতে পারি। আবার সরকার 
যে এই এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সেটিও বুঝতে পারি। কিন্তু এসব ব্যবস্থা এক অদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

অন্যদিকে, শনিবার বিকেলে পিওপিএইচ এর কেন্দ্র আসা ব্যক্তিরা মূলত সীমান্তে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং এনজিওগুলোর শঙ্কা নিয়ে আলোচনা করবেন। 

পিওপিএইচ এর সদস্য মালগোরজাতা রাইচার্স্কা বলেন, এখানে আমরা প্রত্যেকের মতামত শুনি। এই এলাকায় যা ঘটছে তা নিয়ে আমরা প্রতিদিন অনেক কথাই শুনি। গ্রামটিতে অল্প সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন। 

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পরে পুরো ইউরোপের ন্যায় এই অঞ্চলও ইউক্রেনীয়দের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিল৷ কয়েক মাস ধরে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষ পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিল।

এই ঘটনার দুই বছর পর বর্তমানে পোল্যান্ডে বসবাসরত ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ। ইউরোপে প্রায়শই পোল্যান্ডের এই ভূমিকাকে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসাবে দেখা হয়।

এনজিও গ্রুপা গ্রানিকা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ফস্টিন বলেন, আমি আমার আশেপাশে এমন একজনকেও চিনি না যারা তাদের বাড়িতে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের আশ্রয় দেননি। কিন্তু তারা কেন এই কাজটি আফগান, সিরীয় এবং আফ্রিকানদের সাথে করেন না?

পোল্যান্ডে ইউক্রেনীয় এবং অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের স্বাগত জানানোর মধ্যে পার্থক্যগুলো নিয়ে নিয়মিত এনজিওগুলো অভিযোগ জানিয়ে আসছে। 

২০২৩ সালের জুন মাসে পোলিশ মিডিয়া ওকেও প্রেসের জন্য পরিচালিত একটি জরিপে জরিপ সংস্থা ইপসোস জানায়, স্থানীয়দের মধ্যে ৪৩ শতাংশ অভিবাসীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। 

আরও পড়ুন: কাজের ভিসায় রোমানিয়া গিয়ে দুর্দশায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা

অপরদিকে একই জরিপে ৬২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে ইউক্রেনীয়রা যদি দীর্ঘদিন ধরে পোল্যান্ডে থাকেন সেটি দেশের জন্য ভালো হবে।

এনজিওগুলোর মতে, এমন অবস্থা রক্ষণশীল আইন ও বিচার পার্টি (পিআইএস) প্রভাবিত জোরপূর্বক অভিবাসী বিরোধী বক্তব্যের ফলাফল। তারা ২০১৫ সালের মে থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল৷

ওই সময় পোলিশ কর্তৃপক্ষ অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে বেলারুশ সীমান্তে ১৮৬ কিলোমিটার বিস্তৃত একটি প্রাচীর নির্মাণ করেছে। এছাড়া সীমান্তের সেখানে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো এবং অভিবাসীদের বেলারুশের দিকে ‘পুশব্যাক’ করা শুরু করেছে যা জেনেভা কনভেনশন বিরোধী। 

অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ধারণা কখনও কখনও য়াজনোওকা গ্রামে এনজিও পিওপিএইচ এর বিভিন্ন প্রোগ্রামেও উঠে আসে। গ্রামের একজন বয়স্ক বাসিন্দা একটি বৈঠকে বলেন, “সীমান্তরক্ষীদের কেউ তাদের কাজে সহায়তা করে না। অভিবাসীদের সহায়তার প্রয়োজন নেই। আমি তাদের প্রায়শই দেখি এবং অভিবাসীরা অল্পবয়সি ও ভালো স্বাস্থ্যের।”

সীমান্ত অতিক্রম করে এই অঞ্চলে পৌঁছানোর পর অভিবাসীদের পক্ষে সাহায্য পাওয়া প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে। ইরাক থেকে আসা অভিবাসী আলী (ছদ্মনাম) একজন কৃষকের কাছে পানি চেয়েছিলেন। 

polond

‘ওই কৃষক আমি এবং আমার সহযাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলেন ‘কোন সাহায্য নেই'। এখানে মানুষের সাথে সম্পর্ক সবসময় সহজ হয় না।’ যোগ করেন আলী। 

আরেক অভিবাসী আবদুও (ছদ্মনাম) একই কথা স্বীকার করেন। তিনি কয়েক মাস আগে দেশটিতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে পরিবেশ একটু কঠোর কারণ বিদেশিদের সংখ্যা খুবই কম।’

এনজিওকর্মী মালগোরজাটা রাইচারস্কা স্বীকার করে বলেন, ‘মানুষ ভয় থেকে কখনও কখনও সহায়তা প্রত্যাখ্যান করলেও সংহতির ঘটনাও আছে। আমাদের মিটিং চলাকালীন সময়ে আসা অনেক বাসিন্দা আমাদের জানান তারা ইতিমধ্যেই অভিবাসীদের সাহায্য করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ অনেকেই সীমান্ত পার হয়ে আসা ব্যক্তিদের সুপেয় পানি, খাবার ও পোশাক প্রদান করেন। এই সংহতি সবসময় দৃশ্যমান না হলেও এটি বিদ্যমান রয়েছে।’

আলোচিত পোলিশ এনজিও গ্রুপা গ্রানিকায় ২০২২ সাল থেকে কাজ করছেন সাবেক নৃতত্ত্ববিদ জোয়ানা জার্নেকা। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত পরিস্থিতি গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সবসময় কী ঘটছে সে সম্পর্কে খবর রাখেন না। অভিবাসীদের জন্য আমি আমার অনেক কিছু পরিবর্তন করেছি।’

১৭ বছর বয়সি কিশোর মাতেউস তার অবসর সময়ের পুরোটা বিভিন্ন জঙ্গলে অভিবাসীদের জন্য খাবার, পানি কিংবা নতুন জুতা আনতে ব্যয় করেন। 

তিনি বলেন, ‘সরকার সবসময় বলেছিল সীমান্তে সন্ত্রাসীরা এটা করেছে। সেখানে আরও সন্ত্রাসী আছে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম আসলে এই লোকরা কারা। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি অভিবাসী পরিবার এবং সাধারণ মানুষ খুঁজে পেয়েছি। যারা আমার মতোই মানুষ।’

পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে আছেন আফ্রিকান শরণার্থী আবদু। তিনি সম্প্রতি দেশটি বসতি স্থাপন করেছেন। তিনি জানান যে তিনি দেশটিতে ‘এক ধরনের শান্তি’ খুঁজে পেয়েছেন। 

আবদু বলেন, ‘আমি প্রথমে ফ্রান্সে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখানে অনেক লোক আমাকে সাহায্য করেছে। এখন আমি নিজেকে বলি আমি এখানেই ভালো আছি।’

তথ্যসূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস

এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর