বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ঘরে দুধের বাচ্চা, অসুস্থ স্বজন রেখেই ছুটে যান মানবসেবায়

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ২৮ মে ২০২৩, ১০:০৮ এএম

শেয়ার করুন:

ঘরে দুধের বাচ্চা, অসুস্থ স্বজন রেখেই ছুটে যান মানবসেবায়

ঘরে অসুস্থ সন্তান কিংবা আপনজন রেখেই রোগীদের সেবা দিতে হাসপাতালে ছুটে যেতে হয় নার্সদেরকে। আবার নিজে অসুস্থ থাকলেও সেই শরীর নিয়েও চালিয়ে যেতে হয় সেবাকর্ম। এমনকি ৬ মাস- এক বছরের দুধের সন্তান ঘরে রেখে করতে হয় ১২ ঘণ্টা নাইট ডিউটি। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে ধারন ক্ষমতার বেশি রোগীর স্বল্প অপর্যাপ্ত জনবল দিয়েই সেবা চালিয়ে যেতে হয় সেবিকাদের। ঢাকা মেইলের সাথে কথা হয় কয়েকজন নার্সের। তারা শেয়ার করেন তাদের সেবা দানের অভিজ্ঞতা।

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ইউনিটে কর্মরত আছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স নাজমা বেগম (ছদ্মনাম)। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আমাদের এক বছরের একটি বাচ্চা (মেয়ে) আছে। আমার স্বামী সকালে অফিসে বের হয়ে যায়। আমার সন্তানকে পাশেই এক আত্মীয়র বাসায় রেখে রোগীর সেবা দিতে যেতে হয়। আবার অনেক সময় বাচ্চার জ্বর-সর্দি এই জাতীয় হালকা কোনো সমস্যা হলে তাকে বাসায় রেখেই যেতে হয় হাসপাতালে। ওই সময় মনটা ছটফট করতে থাকে বাচ্চার কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এইদিকে রোগীর সেবা দেওয়াটাকে দায়িত্ব হিসেবে বেছে নিয়েছি। তাই সময়ের আগে যেতেও পারি না। এক কথায় বাসায় রোগী রেখে আবার অন্য রোগীর সেবা দিতে হচ্ছে আমাদের।’


বিজ্ঞাপন


২০১৯ সালে করোনা মহামারী শুরু হলে নার্সরা সম্মুখ সারির যোদ্ধার ভূমিকা পালন করেন। শুরুর দিকে তাদেরকে অনেক ভয়ভীতি ও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। সব কিছু উপেক্ষা করে তারা রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন।

একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহানা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘আমার বাচ্চার বয়স যখন মাত্র ৬ মাস। আমি মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে ডিউটিতে জয়েন করেছি। কিছুদিন আমার নাইট ডিউটির রোস্টার পড়ে। ৬ মাসের দুধের বাচ্চাকে বাসায় রেখে নাইট করতে হয়। ওইসময় অনেক কষ্ট হত। রাত ৮টা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা ১২-১৩ ঘণ্টা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো যেত না। আবার অনেক সময় ক্রিটিক্যাল প্যাসেন্টের কাজ করতে হয়। বাসায় গেলে বাচ্চা আমাকে দেখলে অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু আমি পুরোপুরি ফ্রেস না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চাকে কোলে নিতে পারি না। আবার নিজের শরীরও যদি খারাপ থাকে সেই অসুস্থ শরীর নিয়েই রোগীদের সেবা দিতে হয়। খুব অসুস্থ না হলে আমরা ছুটি নেই না।’

২০১৯ সালে করোনা মহামারী শুরু হলে নার্সরা সম্মুখ সারির যোদ্ধার ভূমিকা পালন করেন। শুরুর দিকে তাদেরকে অনেক ভয়ভীতি ও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। সব কিছু উপেক্ষা করে তারা রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন।

করোনা মহামারীর সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে শাহানা বলেন, ‘করোনা মহামারীর শুরুর দিকের অবস্থাটা ছিল অনেক করুণ। যা আমাদের ইতিহাস হয়ে থাকবে। শুরুর দিকে তখন অনেক ভয়ভীতি কাজ করছিল। তখন মুগদা ছিল করোনা ডেটিকেডেট হাসপাতাল। তখন সবথেকে কষ্টের যে জায়গাটা ছিল এই গরমে পিপিই, দুই তিনটা মাস্ক, গোগলস ফেসশিল্ড পড়ে থাকা। পিপিই পড়ে থাকার কারণে পুরো শরীর ঘামে ভিজে যেত। তখন যারা করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি করত তাদের জন্য আলাদা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমি অনেককেই দেখেছি যারা বাসায় ছোট ছোট বাচ্চা রেখে হোটেলে গিয়ে থাকতে হয়েছিল। বাচ্চার সেফটির জন্য মা হোটেলে গিয়ে থাকছিল। আবার আবার শুরুর দিকে করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি করার কারণে আমাদের অনেকের বাসায় কেউ আসতে চাইত না। আবার গ্রামের পরিবারের এক দুশ্চিন্তা। করোনা পরের ধাপগুলোতে অনেক গর্ভবর্তীরাও করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি করেছে। এই ধরনের অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হতে হয়েছে।’


বিজ্ঞাপন


মুগদা মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে কর্মরতা একজন নার্স বলেন, ‘শিশু ওয়ার্ডে রোগীর অনেক বেশি চাপ। বিশেষ করে নাইট শিফটে অনেক কষ্ট হয়। ১৩০-১৪০ পেসেন্টের বিপরিতে নার্স থাকে মাত্র ৩-৪ জন। নাইট শিফট থাকলে আমরা সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে রওয়ানা দেই। সাথে খাবার নিয়ে আসি। কিন্তু রোগীর এত বেশি চাপ থাকে অনেক সময় রাতে খাওয়ার সুযোগ পাই না। কখনো কখনো রাতের খাবার থেকে ১-২টা বেজে যায়।’

তবে আগের থেকে হাসপাতালগুলোতে জনবলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সরকার গেল কয়েক বছরে অসংখ্য নার্স নিয়োগ দিয়েছে। তবে তারপরেও সেটি পর্যাপ্ত নয়। এখনও সরকারি হাসপাতাল গুলোতে সাধারণ ওয়ার্ডগুলোতে ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত অনেক রোগী থাকে। কিন্তু সে হিসেবে নার্স থকে না। এতে বাড়তি চাপ পড়ে তাদের উপর। বিশেষ করে যখন বিভিন্ন আবহাওয়া জনিত কারণে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় তখন অনেক সময় তারা খাওয়ারও সময় পান না।

মুগদা মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে কর্মরতা একজন নার্স বলেন, ‘শিশু ওয়ার্ডে রোগীর অনেক বেশি চাপ। বিশেষ করে নাইট শিফটে অনেক কষ্ট হয়। ১৩০-১৪০ পেসেন্টের বিপরিতে নার্স থাকে মাত্র ৩-৪ জন। নাইট শিফট থাকলে আমরা সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে রওয়ানা দেই। সাথে খাবার নিয়ে আসি। কিন্তু রোগীর এত বেশি চাপ থাকে অনেক সময় রাতে খাওয়ার সুযোগ পাই না। কখনো কখনো রাতের খাবার থেকে ১-২টা বেজে যায়।’

এদিকে সরকারি হাসপাতালে নার্সদের সুযোগ সুবিধা বাড়িয়েছে সরকার। তাদেরকে দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণি মর্যাদা। তবে সরকারি নার্সদের অবস্থার উন্নতি হলেও ভিন্ন চিত্র বেসরকারি নার্সদের ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে তাদের উপর কাজের চাপ আরও অনেক বেশি থাকে। সে তুলনায় তাদরে জন্য নির্দিষ্ট কোনো বেতন কাঠামো নেই বলে জানা গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঢাকার কোনো করপোরেট হাসপাতালে একজন নার্সকে হয়তো ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হচ্ছে, আবার ঢাকার বাইরের কোনো হাসপাতালে ১২-১৫ হাজার টাকাতেও নিয়োগ দেওয়া হয়। তারপরেও ঝুঁকি পরিশ্রম সবকিছু জেনে বুঝেই এই পেশায় এসে মানব সেবার মহৎ কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পান তারা।

টিএই/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর