শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দ্বিতীয় শ্রেণির সুফল মিলছে না অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায়

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৩, ১২:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

দ্বিতীয় শ্রেণির সুফল মিলছে না অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায়

স্বাস্থ্যসেবা খাতের অন্যতম স্তম্ভ নার্সিং পেশা। এ খাতে চিকিৎসকদের মতোই অত্যাবশ্যকীয় নার্সরা। চিকিৎসক ছাড়া হাসপাতাল বা চিকিৎসালয় যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনই নার্স ছাড়াও এ খাত অচল। নার্সিং এমন একটি পেশা যা সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। ব্যক্তিগত কোনো দায় ও সম্পর্ক ছাড়াই নার্সরা রোগীদের স্বাস্থ্য পুণরুদ্ধারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন। মহান এ পেশার গুরুত্ব বিবেচনায় সারাবিশ্বে এটি অত্যন্ত সম্মানের হলেও বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়। বাংলাদেশে অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের পেশাটি এখনও অবেহেলিত।

দীর্ঘ সময় সম্মানজনক এই পেশাটিকে আমাদের সমাজে ছোট করে দেখা হতো। দেশের আর্থ-সমাজিক পরিবেশে নারীদের বাড়ির বাইরে কাজ করাটাকে দেখা হতো নেতিবাচক চোখে। আর নার্সিং পেশায় কর্মরতদের একটা বড় অংশ যেহেতু নারী তাই এই পেশাটিকেও দেখা হতো আঁড় চোখে। তবে সময়ের সাথে সাথে নার্সিং পেশায় পুরুষদের অংশগ্রহণ এবং সর্বোপরি সকল পেশায় নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ায় পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে বর্তমান সরকার নার্সিং পেশাকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেয়। গঠিত হয় আলাদা অধিদফতর ও বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল। যা পেশাটিতে আমূল পরিবর্তন ও ইতিবাচকতা সাধনের লক্ষ্যে করা হয়। যদিও এ ধরনের উদ্যোগ কতটা কাজে এসেছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে পেশা সংশ্লিষ্টদের। 


বিজ্ঞাপন


নাসিং পেশায় কর্মরতদের মতে, এ পেশায় মানোন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল পেশাটিকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পরিণত করা। এতে নার্সিং পেশার প্রতি সর্বসাধরণের আকর্ষণ বেড়েছে। সকল শ্রেণির মানুষ নার্সিং পেশায় আসতে শুরু করেছ। একইসঙ্গে আর্থিক স্বচ্ছলতার সুযোগ বাড়ায় অধিক সংখ্যক মানুষ পেশাটিতে আসতে আগ্রহী হয়েছে। পেশাটিতে বর্তমান কর্মরতদেরও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চাকরির গ্রেডে উন্নয়নের পাশাপাশি পরবর্তীতে আলাদা অধিদফতর ও কাউন্সিল হওয়ায় নার্সরা তাদের স্বতন্ত্র পেশাগত অবস্থান খুঁজে পেয়েছেন। একইসঙ্গে ২০০৮ সালে প্রণীত নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নার্সিং শিক্ষাকে যুগোপযুগী করা হয়েছে বলেও মত তাদের।

dm

তবে এত উদ্যোগের পরেও নানা অসঙ্গতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে কাম্য ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। নার্সরা সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে যোগদানের পর তাদের আর পদোন্নতি হচ্ছে না। হাতে গুনা কয়েকজনের পদোন্নতি হলেও তা এমন সময় হচ্ছে যখন তাদের কর্মজীবন শেষ। নার্সিং অধিদফতর ও কাউন্সিলের নেতৃত্বে অ-নার্স ব্যক্তিরা থাকায় মতানৈক্য দেখা দিচ্ছে। ওইসব পদে থাকা আমলারা নার্সদের প্রয়োজন অনুধাবন করতে পারেন না। আবার অনেক সময় তারা নার্সিং পেশা সংশ্লিষ্টদের যথার্থ মূল্যায়ন করছেন না বলেও অভিযোগ নার্সদের। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে নার্সদের নিয়োগ যোগ্যতা ভিত্তিতে হলেও বেসরকারি খাত সম্পূর্ণই যথেচ্ছভাবে চলছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের তদারকির ঘটতি রয়েছে। ফলে সরকারের নানা উদ্যোগের ফলেও পেশাটিতে ইতিবাচকতার হাওয়া খুব অল্পই লাগছে।

নানা অনিয়মে দ্বিতীয় শ্রেণির সুফল নেই 

এসব বিষয়ে নার্সিং পেশায় কর্মরতদের দুইটি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা দ্বিতীয় শ্রেণিপ্রাপ্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ এবং এ পেশার উন্নয়নে তার প্রদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তবে সরকারের নানা উদ্যোগের পরেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে নার্সিংয়ে গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না বলে জানান তারা। বিশেষ করে পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতায় এতসব উদ্যোগ ইতিবাচকতা তৈরিতে কার্যত ব্যর্থতায় পতিত হয়েছে বলে মত তাদের। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস ওয়েলফেয়ারের সভাপতি ইসমত আরা পারভিন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার উদ্যোগেই প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনুষ্ঠানে এসে নার্সিং পেশাকে দ্বিতীয় শ্রেণি ঘোষণা করেছিলেন। এ মর্যাদা পাওয়ায় নার্সিংয়ে পড়াশুনার গুরুত্ব ও সুযোগ বেড়েছে। মেধাবিরা এই পেশার দিকে ঝুঁকছেন। নার্সিংয়ে আবেদনের সর্বনিম্ন গ্রেড ৭ কিন্তু ৮ এর নিচে এখন আর কেউ ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। মেধাবি শিক্ষার্থীরা আসায় প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছে। অনেক নার্স বিএসসি নার্সিং পড়ছে। অনেকে পোস্ট গ্রেজুয়েশন সম্পন্ন করছে। আমাদের প্রফেশনে অনেক মেধাবিরা আসছে, তাদের ক্যারিয়ারকে সামনে বাড়ানোর সুযোগ প্রয়োজন। তাহলে সেখান থেকে হয়তো সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়া মতো লোকও বের হয়ে আসবে। যা এ পেশার ব্যাপারে মানুষের ধারণা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেবে। কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। 

তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদার পর প্রথম শ্রেণিতেও পদ তৈরি করা হয়েছে। তবে নবম গ্রেডের উপর পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সময় মতো পদোন্নতি হচ্ছে না। নবম গ্রেডে অল্প কয়েকজন পদোন্নতি পেয়েছে। কিন্তু তারা এমন সময় পদোন্নতি পেয়েছে যে, আজ পদে যোগ দিয়ে দুইদিন পরেই তারা এলপিআরে চলে গেছেন। লিস্টে নাম আসা অনেকে অবসরে চলে গেছেন। এ পেশার উন্নয়নে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদের লোক প্রয়োজন। নার্সদের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার সুযোগ প্রয়োজন। যেন আমাদের থেকেই নার্সিং অধিদফতরের মহাপরিচালক হতে পারে। আমরা আলাদা অধিদফতর পেয়েছি কিন্তু পরিচালক পর্যায়েও আমাদের পেশার কেউ নেই। আমরা সম্মান পেয়েছি কিন্তু সেটা একটা পর্যায়ে এসে থেমে যাচ্ছে। তা প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। সেই সুযোগ তৈরি করলে যোগ্য লোকও তৈরি হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন।

dm

স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) মহাসচিব মো. ইকবাল হোসেন সবুজ ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশের নার্সিংয়ে যা উন্নয়ন হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এসেছে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার পর আমাদের পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়টি অবহেলিত হয়েছে। দুই ধাপে সাড়ে চারশোর মতো নার্সকে প্রথম শ্রেণিতে পদোন্নতি হয়েছে। বর্তমানে নার্সিংয়ে পদোন্নতির হাজার হাজার পোস্ট খালি কিন্তু সেসব পদে পদায়ন হয়নি। আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে যোগদান করি, আবার অবসরেও যাই একই পোস্টে। এর মূল কারণ নিয়োগ সংক্রান্ত আমাদের কোনো নিয়ম নেই। প্রধানমন্ত্রী যে অবদান রেখেছেন তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিলেও তা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার অভাবে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে নার্সিং পেশা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নও হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক একজন চিকিৎসক। তিনি জানেন চিকিৎসকদের কিভাবে পদোন্নতি দিতে হবে। কিভাবে তারা হাসপাতালে কাজ করে। কিন্তু আমাদের মহাপরিচালক একজন নন-মেডিকেল মানুষ। তারা বিষয়টি ঠিকভাবে অনুধাবন করেন না। তারা নার্সিং সংগঠনসহ নার্সদের যথাযথ মূল্যায়ন করেন না। আমাদের থেকে কখনও কোনো পরামর্শ তারা নেন না। নার্সিং খাত যথেচ্ছভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এর বাজে প্রভাব তাদের কাজেও প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন সর্বশেষ নার্সিং কাউন্সিলে দুইজন নার্সকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় তা ফুটে উঠেছে। ডিজি আসেন, ডিজি যান কিন্তু তারা এ পেশার গুনগত মানোন্নয়নে কোনো কাজ করেন না। তারা তাদের রুটিন দায়িত্ব পালন করে যান। 

এসময় নার্সিং খাত দুর্নীতিবাজ ও সরকার বিরোধী ব্যক্তিদের হাতে পরিচালিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন স্বানাপ মহাসচিব।

dm

প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে

এ বিষয়ে ইসমত আরা পারভিন বলেন, প্রশিক্ষণের বিষয়ে সরকার আন্তরিক। নিয়মিত নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটি রয়ে গেছে লোক নির্বাচনে। কাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং কারা কোন সেক্টরে কাজ করবে তা স্থানীয় হাসপাতাল প্রশাসন ঠিক করে দেয়। ফলে সেখানে সঠিকভাবে নির্বাচন ও প্রশিক্ষিতদের কাজে লাগানো হচ্ছে না। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ এখনও নার্সদের অনুকূলে আসেনি। অনেক সময় নার্সরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন। এই বিষয়ে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে এবং নজর দিতে হবে।

ইকবাল হোসেন সবুজ বলেন, কর্মক্ষেত্রে নার্সদের জন্য নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রশিক্ষণের বিষয়েও ঘাটতি রয়েছে। যারা নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয় তারা নিজেরাই এসব বিষয়ে কতটা প্রশিক্ষিত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কিভাবে, কে তাদের সিলেকশন করে তা কেউ জানে না। আর যারা করে তাদের এ পেশার বিষয়ে কতটা ধারণা রাখেন নিয়ে সন্দেহ আছে। যে নার্সিংয়ের প্রশাসনিক পদে যাদের রাখেন, তারা চাকরির শেষ পর্যায়ের মানুষ। তারা শুধু সেখানে নামে মাত্র থাকেন।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর