সারাবিশ্বে স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দিনটি স্মরণে প্রতি বছর সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরই একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। যার সারকথা ‘Health for All’ বা সবার জন্য স্বাস্থ্য। সংস্থাটির সদস্য হিসেব স্বাধীনতার পর থেকেই নানা আয়োজনে বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপন করা হয়।
১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বিজয়ী যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো ও উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে আসা এক গৌরবের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধকালীন ফিল্ড হাসপাতাল থেকে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। সারাদেশে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি; বৈশ্বিক মহামারি করোনায় মৃত্যু হার ২ শাতংশের নিচে রাখা থেকে একদিনে এক কোটি ২০ লাখ টিকা প্রদান বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এগিয়ে যাওয়ার বার্তা বহন করে। তবে এত সফলতার পরেও সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা কতটা নিশ্চিত হয়ে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির ব্যয়, রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, রোগীদের বিদেশমুখী মনোভাব, সরকারি হাসপাতালে সেবা গ্রহণে ভোগান্তি, বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসায়ী মনোভাব এ খাতের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিজ্ঞাপন
সবার জন্য সেবা নিশ্চিতে বড় অন্তরায় ব্যক্তি ব্যয়
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের (বিএনএইচএ) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে স্বাস্থ্য খাতে দেশে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭৭ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার বা ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ, সরকারের ছিল ২৩ দশমিক ১ শতাংশ, উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশ। বাকি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর।
প্রতিবেদনে ১৯৯৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকারের অংশের ব্যয় ক্রমান্বয়ে কমছে এবং ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
যদিও আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার ৩২ শতাংশে নামানোর জন্য সরকারের একটা রূপরেখা ছিল। প্রথমে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির’ (এসএসকে) পরিকল্পনা ছিল, যার অধীনে শুধু দরিদ্র জনগণকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হবে। ধীরে ধীরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এর মধ্যে সম্পৃক্ত করা এবং একটা হেলথ ইন্সুরেন্স করা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তার উল্টো।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ২৪ শতাংশ মানুষ ‘বিপর্যয়মূলক’ ব্যয়ের মধ্যে পড়ছেন। এছাড়া চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন এবং ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যান না।
এ অবস্থায় দেশের স্বাস্থ্যখাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন বলে মনে করেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করেন তারা। তবে সামগ্রিকভাবে নীতির পরিবর্তন না হলে দৃশ্যমান এই উন্নয়ন কাজে আসবে না বলেও মনে করেন অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দেশের স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে যাচ্ছে, তবে তা হওয়া উচিত পরিকল্পিত
দেশের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের হেলথ কেয়ারের অবকাঠামো অনেক উন্নত। ইতোমধ্যে আমরা এমডিজি গোল বাস্তবায়ন করেছি। মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হার কমানোর জন্য বাংলাদেশ পুরস্কৃত হয়েছে। ভ্যাকসিনেশনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার পেয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৯৭টি থানায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স করেছিলেন, তখন দেশে মাত্র ৩৭টি হাসপাতাল ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছেন। আমার ২৮টি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এর মধ্যে মেটফরমিনের মতো ডায়াবেটিকের ওষুধও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, প্রয়োজনে এসব ক্লিনিকে বিনামূল্যে ইনসুলিন প্রদান করবেন। আমাদের ৩৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি পর্যন্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রথমিক স্বাস্থ্য সেবা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তিনি তা দেখিয়েছেন।’
বিএসএমএমইউ ভিসি বলেন, বর্তমান সরকার তৃণমূল থেকে টারসিয়ারি পর্যায় পর্যন্ত সেবার পরিধি বাড়িয়েছে। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লস্টিক সার্জারি হাসপাতাল সারাবিশ্বে সর্বাধিক শয্যার প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এক হাজার ২০০ বেডের একটি অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল। এটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল। একইসঙ্গে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য হাসপাতালগুলোকেও অধিক রোগীকে মানসম্মত সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। বিএসএমএমইউর অধীনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু করা হয়েছে। এখানে সকল ধরনের চিকিৎসা বাংলাদেশেই হবে, যেন রোগীদের দেশের বাইরে না যেতে হয়। এটি সম্ভব তা আমরা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছি। করোনাকালে আমরা সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ সবাইকে সেবা দিয়েছি। কাউকে দেশের বাইরে যেতে হয়নি।
তবে সেবা খাতটিতে এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. মো. রেদওয়ান আহমেদ। ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও রিসার্চ সেন্টারের প্রধান গবেষক এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক এই বিভাগীয় প্রধান ঢাকা মেইলকে বলেন, স্বাস্থ্যখাতে আমাদের যে ঘাটতি রয়েছে তা করোনা মহামারিকালে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের প্রধান ঘাটতির স্থান কোয়ালিটি হেলথ কেয়ার। কারো সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে কোয়ালিটি হেলথ কেয়ার পাওয়ার। আমাদের স্বাস্থ্যখাতের সবথেকে দুর্বলতম স্থান হচ্ছে আমাদের হেলথ সিস্টেমের গুরুতর যে ঘাটতিগুলো আমাদের চোখের সামনে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোকে আমরা শনাক্ত করিনি। মনে হচ্ছে আমরা তা ভুলে গেছি। আরেকটি মহামারি না এলে হয়ত আমাদের তা মনে পড়বে না।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিটি স্লোগানের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে, দুনিয়াজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি দরকার। এখন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কোয়ালিটি হেলথ কেয়ারের সবথেকে বড় প্রমাণ হচ্ছে ভোক্তার সন্তুষ্টি। একইসঙ্গে রোগী নিরাপত্তার স্থানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। যা পূরণ করার জন্য আমাদের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রিফর্ম প্রয়োজন। সবার জন্য স্বাস্থ্য আমরা বহুদিন বলে আসছি, কিন্তু তা এখনও সুদূর পরাহত রয়ে গেছে।
যেতে হবে বহুদূর
অগ্রগতির স্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু এখনো অনেক করণীয় রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি আমাদের প্রতিরোধের দিকে আরও নজর দিতে হবে। যেমন: হৃদরোগ কেন হয়? কেউ যদি লবণ বেশি খায়, ধূমপান করে, মানসিক চাপ নেয়, কায়িক পরিশ্রম না করে, খাওয়া দাওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে পড়ে তবে তাদের হার্টের রোগ বেশি হয়। আমরা এ বিষয়গুলোতে সচেতন করার চেষ্টা করছি। লাঙ ডিজিজ বায়ু দূষণের জন্য হয়। এক্ষেত্রে আমরা জানি বাংলাদেশ বায়ু দূষণের দিক থেকে নিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এটি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এসব বিষয়ে উন্নয়নে আমাদের ব্যাপকভাবে গবেষণা করতে হবে। সবাইকে গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে শুরু করেছি। আমাদের আরও বেশি বেশি প্রতিরোধমূলক গবেষণা করতে হবে।’
স্বাস্থ্য ইনসুরেন্সের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ট্যাক্স আরোপের কথা ভাবা যেতে পারে। যেমন মোবাইল ব্যবহারকারীরা একটি নির্দিষ্ট এমাউন্টের স্বাস্থ্য ট্যাক্স দেবেন। সেই ট্যাক্সের মাধ্যমে আমারা ইনসুরেন্স ব্যবস্থা করতে পারি। সবার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে সকল প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্মীদের হেলথ ইনসুরেন্সের আওতায় আনতে হবে।’
সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক রেদওয়ান আহমেদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বাজেট নেই তা বলার সুযোগ নেই। প্রতিবছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাজেট ফেরত আসে। সরকার যে টাকা দেয়, তারা তা ব্যবহার করতে পারে না। এ অবস্থায় অব্যবহৃত অবস্থায় টাকা ফেরত যাচ্ছে কিন্তু মানুষকে সেবা দিতে পারছে না। আমাদের লোকজন ফ্লোরে ঘুমাচ্ছে, চাইলেই প্রতিটি পরীক্ষা করতে পারছে না, সরকারি হাসপাতালে সকল সেবা পাচ্ছে না, ফলে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। এই বিষয়গুলো আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারণ আমাদের নীতিনির্ধারক ও সংসদ ব্যবসায়ী বান্ধব। তারা মনে করছে স্বাস্থ্যখাত সরকারের জন্য একটি দায়। এখাতে আমরা শুধু খরচ করি, এখান থেকে কোনো লাভ আসে না। এই চিন্তাধারা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।’
রাজনৈতিক ঐক্যমতে প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ একটি সূদুর প্রসারি বিনিয়োগ তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। এখাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি সক্ষমতাওে বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী বাজেট ও ক্রম করার ক্ষমতা দিতে হবে। যার যা দরকার সে সেই উপাদান কিনবে, ঢাকাকেন্দ্রিক নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ক্রয় বন্ধ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিকভাবে কমিটমেন্ট প্রয়োজন। এ নিয়ে আমাদের মুক্ত আলোচনা হতে হবে। যেমনটা আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে হয়।
এমএইচ/জেবি