বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নগর স্বাস্থ্য: সংক্রামক রোগের সংক্রমণ ও প্রতিরোধ

ডা. শামীম হায়দার তালুকদার
প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০২৩, ০৮:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

নগর স্বাস্থ্য: সংক্রামক রোগের সংক্রমণ ও প্রতিরোধ

চট্টগ্রামের হালিশহরের কাছে একটা বস্তিতে থাকেন রবিউল আর রুখসানা। রুখসানা বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন, আর রবিউল রিকশা চালান। হঠাৎ একদিন রবিউল আগে আগে বাসায় ফিরে আসেন। তার শরীর ব্যাথা আর অল্প জ্বর। পরের দুইদিন জ্বর বাড়ে, সাথে শরীর ব্যাথাও বাড়ে। শুধু এটুকুই নয়, রুখসানা দেখে রবিউলের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট গোটা উঠেছে। পরদিন গোটা আরও বাড়ে। রবিউল ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার সাহেব জানান, ওর জলবসন্ত হয়েছে। এটা সংক্রামক রোগ, তাই কয়েকটা দিন ওকে লোকজন থেকে আলাদা থাকতে হবে। রবিউল জানতে চায়, সংক্রামক রোগ কী? ডাক্তার সাহেব ওকে বুঝিয়ে বলেন, যে রোগে একজন থেকে আরেকজন আক্রান্ত হয় তাকে সংক্রামক রোগ বলে। যেমন একজনের যদি বসন্ত হয় তাহলে তার হাঁচি, কাশি বা গোটাগুলো ফেটে গিয়ে যে পানি বের হয় তা থেকে অন্যদের মাঝে ছড়াতে পারে এই রোগ। আবার রোগীর কাপড়, বিছানার চাদর বা বালিশের কভার থেকেও রোগ ছড়াতে পারে। তাই যতদিন গোটাগুলো শুকিয়ে না যায় ততদিন আলাদা থাকতে হবে। ডাক্তার সাহেব রবিউলকে বেশি করে পানি পান করতে উপদেশ দেন, সাথে পুষ্টিকর খাবারও খেতে বলেন।

সংক্রামক রোগ বলতে বোঝায় ক্ষতিকর জীবাণু (প্যাথোজেন) দ্বারা সৃষ্ট অসুস্থতা যা বাইরে থেকে শরীরে প্রবেশ করে। সংক্রামক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলোর মধ্যে রয়েছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরজীবী এবং খুব সামান্য সংখ্যক প্রিয়ন। ফ্লু, হাম, জলবসন্ত, এইচআইভি, কোভিড-১৯ ইত্যাদি সংক্রামক রোগের উদাহরণ।


বিজ্ঞাপন


বিভিন্নভাবে রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। অন্য মানুষের হাঁচি, কফ বা ব্যবহৃত পোশাক থেকে সংক্রামক রোগ ছড়াতে পারে। পোকার কামড়, দূষিত খাবার, পানি বা মাটি ইত্যাদি থেকেও রোগ ছড়াতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে অথবা কেউ যদি এমন এলাকায় ভ্রমণ করে যেখানে রোগের সংক্রমণ বেশি তাহলে যে কেউ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যারা বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন, যেমন যারা ক্যান্সার বা এইচআইভির চিকিৎসা নিচ্ছেন, বা নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন করছেন তাদেরও ঝুঁকি বেশি। আবার যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম, যেমন ছোট শিশু, গর্ভবতী নারী এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। যারা সাধারণত সংক্রামক রোগের টিকা গ্রহণে বিরত থাকেন তাদেরও ঝুঁকি কম নয়। স্বাস্থ্যকর্মীরা উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। যেখানে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ভাইরাস এবং জিকা ভাইরাসের মতো রোগজীবাণু বহন করে এমন মশার উপস্থিতি বেশি সেখানে অবস্থানকারী মানুষও ঝুঁকিতে থাকেন। [১]

অধিক মানুষের বসবাসের জন্য শহরাঞ্চালে বিশেষ করে ঢাকার মতো বড় শহরে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবও বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বাসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৭%। আর শুধুমাত্র ঢাকায় ৪০% জনসংখ্যা রয়েছে। অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ২৯% এবং ৩০৯টি পৌরসভা শহরে ৩১% জনসংখ্যা আছে [২]।

ঢাকা শহরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভেক্টর-বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব, বিশেষ করে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বেশ প্রকোপ দেখা দিয়েছে। প্রথমবারের মতো চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০১৭ সালে। ডেঙ্গুর প্রথম আবির্ভাব হয় ২০০০ সালে। এরপর থেকে প্রতি বছর ডেঙ্গুর ছোট আকারের প্রাদুর্ভাব ঘটতে থাকে। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে সংক্রমণ সব রেকর্ড ভেঙে দেয় এবং এক লাখেরও বেশি ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় [৩]।

২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই। বাংলাদেশে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ঢাকায় আক্রান্তের হার ছিল ২৩২১.৭/১,০০০,০০০। [৪]


বিজ্ঞাপন


রোগের সংক্রমণ বেশি হলে বা মহামারি দেখা দিলে দেশ বিশেষ আইনের অধীনে পরিচালিত হয়। জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশে আইন তৈরি হয়। এই আইনে যেসব রোগকে সংক্রামক রোগ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো হলো- ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়াসিস, ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এভিয়ান ফ্লু, নিপাহ, অ্যানথ্রাক্স, মারস-কভ, জলাতঙ্ক, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, ডায়রিয়া, যক্ষ্ম, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, এইচআইভি, ভাইরাল হেপাটাইটিস, টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য রোগ, টাইফয়েড, খাদ্যে বিষক্রিয়া, মেনিনজাইটিস, ইবোলা, জিকা, চিকুনগুণিয়া এবং সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা ঘোষিত কোনো নবোদ্ভূত বা পুনরুদ্ভূত রোগ।

আইনে বলা হয়, রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাক না কেন, এই আইনের বিধানগুলোই প্রাধান্য পাবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিন করা হবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি কমিটির সদস্য সচিব হবেন। কমিটির দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংক্রামক রোগের বিস্তার থেকে জনগণকে সুরক্ষা দানের লক্ষ্যে করণীয় সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে এই কমিটি। সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ঔষধের ব্যবহার পর্যালোচনা করা। রোগের প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, এ সংক্রাস্ত শিক্ষা বিস্তার ও অন্যান্য পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব কি হবে সে সম্পর্কেও আইনে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিস্তার থেকে জনগণকে সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রমিত এলাকাকে সংক্রমণমুক্ত এলাকা থেকে আলাদা করা, সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক ঔষধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার এবং অপব্যবহার রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জীবাণুঘটিত দূষণ প্রতিরোধ ও রোগ সংক্রমণের উৎস অপসারণ বা ধ্বংস করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রয়োজনে সংক্রামক রোগের বিস্তর রোধে বাজার, গণজমায়েত, স্টেশন, বিমানবন্দর, নৌ ও স্থলবন্দরগুলি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করবে। যানবাহনে দেশে আগমন, নির্গমন বা দেশের অভ্যন্তর চলাচল নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। [৫]

২০২০-২০২১ এ সারা পৃথিবীর সাথে সাথে বাংলাদেশের মানুষও কোভিড-১৯ নামক সংক্রামক ব্যধির ভয়াবহতা দেখেছে। করোনাকালে দেশে যে ভয়াবহ দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছিল সে পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের মানুষের সামগ্রিক নিরাপত্তার দায়িত্ব আইনগতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপরে বর্তায়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত থাকলেও সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো বিভাগকেও আইন প্রয়োগ করতে দেখা গিয়েছে তখন। ফলে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। মানুষ কারণে-অকারণে বাইরে বেরিয়েছে, এ শহর সে শহর ঘুরে বেড়িয়েছে- তাতে সংক্রমণের হার বেড়েছে। এই সমন্বয়হীনতার ফলে দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ বিলম্বিত হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা সফল হয়েছি। সফলভাবে টিকা কার্যক্রমও সম্পন্ন হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়হীনতা আর নয়, সুস্থ-সুন্দর জাতি গঠনে সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়- বিশেষজ্ঞদের এই বক্তব্যের সাথে আমরাও একাত্মতা প্রকাশ করি।

লেখক
ডা. শামীম হায়দার তালুকদার
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলাপমেন্ট
কনসালটেন্ট, ইউনিসেফ

Refernce:
1.     Infectious Disease: Types, Causes & Treatments Available online: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/17724-infectious-diseases (accessed on 26 September 2022).
2.     CBHC Available online: http://www.communityclinic.gov.bd/urban-health-page.php (accessed on 4 July 2022).
3.     Hossain, M.S.; Amin, R.; Mosabbir, A.A. COVID-19 Onslaught Is Masking the 2021 Dengue Outbreak in Dhaka, Bangladesh. PLoS Negl. Trop. Dis. 2022, 16, e0010130, doi:10.1371/journal.pntd.0010130.
4.     Nasir, M.; Chowdhury, A.; Zahan, T. Self-Medication during COVID-19 Outbreak: A Cross Sectional Online Survey in Dhaka City. Int. J. Basic Clin. Pharmacol. 2020, 9, 1325–1330, doi:10.18203/2319-2003.ijbcp20203522.
5.     সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ Available online: http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1274.html (accessed on 27 September 2022).

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর