শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শিশুদের অতি চঞ্চলতা কি মানসিক বিকাশে বাধা দেয়?

অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু
প্রকাশিত: ১৪ মার্চ ২০২৩, ০১:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

শিশুদের অতি চঞ্চলতা কি মানসিক বিকাশে বাধা দেয়?

শিশুদের অতিমাত্রায় চঞ্চলতা, অতি আবেগ এবং অমনোযোগিতাকে এডিএইচডি বলা হয়। এই রোগটি ১২ বছরের কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে ১ থেকে ৪ বছর বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। অতিমাত্রায় চঞ্চলতা এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুর প্রথম উপসর্গ। শতকরা ৫ ভাগ শিশুর মধ্যে এডিএইচডি রোগটি পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য এটিকে শিশুদের বড় স্নায়ু বিকাশজনিত আচরণগত সমস্যাও বলা হয়।

সাধারণত ছেলে শিশুদের মাঝে মেয়েদের তুলনায় এটি ৩ গুণ বেশি পরিলক্ষিত হয়। নির্দিষ্ট কোনো কারণ এটির জন্য দায়ী নয়। একাধিক কারণে শিশুর এ রোগ হতে পারে। যেমন: যমজ শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি। পিতা-মাতার এ রোগ থাকলে শিশুদের মধ্যে আসার সম্ভাবনা ৫০ ভাগেরও বেশি। কারণ জীনগত প্রভাবেই এটি বেশি হয়। এছাড়া মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তন, স্নায়ুবিক রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য, হরমোনজনিত সমস্যা, মস্তিষ্কের প্রদাহ, পরিবেশগত কারণসহ নানা কারণে শিশুদের মধ্যে এ রোগ দেখা দেয়।


বিজ্ঞাপন


জীনগত কারণের মধ্যে বিজ্ঞানীরা শরীরে ডোপামিন (Dopamine) রিসেপ্টরে জেনেটিক মিউটেশনকেই মূলত এ রোগটির জন্য দায়ী বলে মনে করন। এরমধ্যে অন্যতম মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তন যেমন: মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের (Basal ganglia & Frontal lobe) আকৃতি ছোট হওয়া ইত্যাদি।

মস্তিষ্কের প্রদাহ বলতে বাচ্চা গর্ভে থাকা অবস্থায় রুবেলা ভাইরাস, সাইটোমেগালো ভাইরাস (CMV), হারপিস সিম্পেক্স ভাইরাস, এইচআইভি ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হলে হতে পারে। পরবর্তীতে নবজাতকের মস্তিষ্কে কোনো জীবাণু সংক্রমণের কারণে যেমন: মেনিনজাইটিস এবং এনসেফলাইটিস হলেও এরকম হতে পারে। কখনো কখনো এসকল শিশুদের রক্তে সিসার (লেড) আধিক্য অথবা হরমোনের তারতম্য দেখা যায়। আর ফাস্টফুড, ফুড এডিটিভস্, খাদ্য রঙিন করার রং (Coloring agent), খাদ্যকে অধিক দিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত দ্রব্যাদি (ফুড প্রিজারভেটিভস) এ রোগের প্রখরতাকে বাড়িয়ে দেয় বলেও বিজ্ঞানীদের ধারণা।

এডিএইচডি রোগের উপসর্গ হলো-

১. এডিএইচডি শিশুরা অতিমাত্রায় অমনোযোগী এবং অতি-চঞ্চল হয়ে থাকে।
২. এ শিশুরা এক জায়গায় স্থির থাকে না।
৩. স্কুলে শিক্ষকদের কথায় মনোযোগ না দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে।
৪. স্কুলের প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন: খাতা কলম হারিয়ে ফেলে।
৫. পড়াশুনায় মনোযোগ না থাকায় স্কুলের রেজাল্ট খারাপ হতে পারে।
৬. কোনো কাজ সম্পন্ন না করে সেটি ছেড়ে অন্যটি ধরে।
৭.  কখনো কখনো ক্ষিপ্ত ও আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে।
৮. বেশি কথা বলে এবং প্রশ্ন শেষ হওয়ার পূর্বেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে।
৯. নিজের ইচ্ছা মতো চলতে পছন্দ করে।
১০. পরিণতি না বুঝে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে বসে।


বিজ্ঞাপন


চিকিৎসা ব্যবস্থা

এই রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা নির্ভর করে শিশুর বয়স, রোগের উপসর্গ ও মাত্রার ওপর। এ জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিটি শিশুর জন্য ভিন্ন ভিন্ন। এর চিকিৎসায় বাজারে অনেক ধরনের ওষুধ রয়েছে। যেমন: মিথাইল ফেনিডেট, রিসপেরিডন, ডেক্সএমফিটামিন, এটোমক্সেটিন, ইমিপ্রামিন জাতীয় ওষুধ এ রোগের উপসর্গকে কমাতে সাহায্য করে। এসব ওষুধে সাধারণত ৭৫ থেকে ৯০ ভাগ শিশুর উপসর্গ দূর হয়। তবে এসব ওষুধ অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে।

খাবারের সীমাবদ্ধতা

ধারণা করা হয় কোনো কোনো খাবার এ রোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। তাই এডিএইচডি শিশুদের ক্ষেত্রে ফাস্টফুড, চকলেট, সস, মেগা ভিটামিন, ফুড এজিটিভস, খাবারে প্রিজারভেটিভ, রঙিন খাবার ইত্যাদি পরিহার করা খুবই জরুরি। এছাড়া ওষুধের পাশাপাশি কিছু কিছু ব্যবহারিক শিক্ষা যেমন: নিউরো বিহ্যাবিয়ার থেরাপি, সেন্সরি থেরাপি ইত্যাদি) রোগের মাত্রা কমানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অভিভাবকদের জন্য উপদেশ

১. স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে শিশুর সমস্যাটি শেয়ার করা।
২. শিশুর প্রতিদিনের রুটিন তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী তাকে দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত রাখা।
৩. শিশুকে শান্ত রাখার ব্যবস্থা করা।
৪. শিশুকে সহজ সহজ ভাষায় উপদেশ দেওয়া এবং ভালো আচরণ করা।
৫. একই সঙ্গে অনেক কাজ না দিয়ে ছোট ছোট নির্দেশনামূলক কাজ করানো।
৫. অন্য শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সুযোগ দেওয়া।
৬. শিশুকে নতুন নতুন সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া।
৭. শিশুকে বাসার ছোট ছোট কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
৮. ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করা।
৯. মন্দ কাজের জন্য বেশি কঠিন না হয়ে বুঝাতে চেষ্টা করা।

এডিএইচডি শিশুর স্কুল শিক্ষকদের জন্য কিছু নির্দেশনা, যা মেনে চললে এ রোগের মাত্রা কমে যেতে পারে:

১. স্কুলে এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুকে প্রথম সারিতে বসার ব্যবস্থা করা। 
২. তাদের নিয়মিত মনিটরিং করা।
৪. তাদের ভালো ফলাফল এবং ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করা।
৫. পড়ার সময়কাল যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করা। 
৬. নিয়মিতভাবে কাজের ফলাফল যাচাই করা।

শিশুর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই লক্ষণগুলো অনেকাংশে কমলেও কিছু সমস্যা থাকতে পারে, যা পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। তবে ছোট বয়সে শিশুর মধ্যে এ রোগের উপসর্গ দেখা দিলে শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। তাই রোগের প্রাথমিক অবস্থায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে শিশুর মানসিক বিকাশ অনেকটাই স্বাভাবিক হয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।

লেখক: চেয়ারম্যান, শিশু নিউরোলজী বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এমএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর