শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ডায়রিয়া রোগীদের ভরসা আইসিডিডিআর’বি ও কলেরা হাসপাতাল

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৭:৪৩ এএম

শেয়ার করুন:

ডায়রিয়া রোগীদের ভরসা আইসিডিডিআর’বি ও কলেরা হাসপাতাল

‘ডায়রিয়া হলে এইখানে না আনলে ভালো হয় না’, এভাবেই রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) ও কলেরা হাসপাতালে আসার কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন ময়ময়নসিংহ থেকে আগত জোবেদা খাতুন। ষাটোর্ধ্ব এই নারী পূত্রবধুকে সঙ্গে করে দুই নাতনিকে নিয়ে হাসপাতালটিতে এসেছেন। তাদরে বাড়ি ময়ময়নসিংহের গফরগাঁও উপজেলায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত চার ও একবছর বয়সী দুই নাতনিকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে হাসপতালে আছেন তিনি।

রোগী নিয়ে হাসপাতালে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) রাত ১টা থেকে রোগী নিয়ে হাসপাতালে আছি। একজনের বয়স ৪ বছর, আরেকজনের একবছর। গত তিন-চারদিন যাবত দুইজনের ডায়রিয়া আর বমি। প্রথমে বড় জনের বমি শুরু হয়েছে, পরে পেটের সমস্যা। একইদিন রাতে ছোটজনেরও একই অবস্থা। পরে সোমবার রাত ৪টার সময় এই হাসাতালে নিয়ে আসছি। ওইদিন দেখে কিছু ওষুধ আর সেলাইন দিয়ে সকাল ৭টায় ছুটি করে দিছে। মঙ্গলবার বেলা ২টায় বাড়িতে পৌঁছেছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল। এরপর আবার ডায়রিয়া আর বমি করা শুরু করেছে। পরে ৫ হাজার টাকা মাইক্রো ভাড়া করে  আবার নিয়ে আসছি ‘

আইসিডিডিআর’বি কলেরা হাসপাতালে না আনলে ডায়রিয়া রোগী ভালো হয় না বলেও মনে করেন ষাটোর্ধ্ব এই নারী। 

বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষাকালের শুরুর আগে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। সেই অনুযায়ী এখন মওসম না হলেও সরজমিনে হাসপাতালটিতে ঘুরে রোগীর চাপ লক্ষ্য করা গেছে। আগত রোগীদের একটি বড় অংশ রাজধানী ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ও জেলার বাসিন্দা। কেউ সরাসরি এইখানে নিয়ে এসেছেন আবার অনেকে অন্য হাসপাতাল থেকে রেফারে এখানে নিয়ে এসেছেন।

তেমনই একজন রোগীর স্বজন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শামীমা আক্তার। স্বামীকে নিয়ে গত তিনদিন যাবত কলেরা হাসপাতালে আছেন তিনি। জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, রোগী আমার স্বামী। তার রোগীর বয়স ৬৫ বছর। আজকে তিনদিন যাবত এখানে ভর্তি আছে। আমাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। রোববার থেকে এই সমস্যা। প্রথম ভেবেছি টুকিটাকি ওষুধ খাওয়ালে ঠিক হয়ে যাবে। পরে দেখি অবস্থা খারাপ, তখন নিয়ে আসছি। নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে দুইবার গেছি। ওইখান থেকে এখানে পাঠিয়েছে।

হাসপাতালে সেবার মানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডাক্তার-নার্সরা ভালো। সিট পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। রোগী অনেক বেশি, তবে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকে। কেউ কেউ তো কয়েক ঘণ্টা থেকেই চলে যায়।’


বিজ্ঞাপন


এ সময় নিজের রোগীর বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে শামীমা আক্তার বলেন, ‘সবার রোগী ভালো হয়ে যায়। আমার রোগী ভালো হয়না। বমি আর ডায়রিয়া বন্ধ হয় না।’

ঢাকার বাইরের রোগীর মতো স্থানীয় রোগীও রয়েছেন। তাদের অনেকে আবার সাম্প্রতিক সময় কলেরার ভ্যাকসিন পাওয়া এলাকা থেকেও এসেছেন। এমনই একজন আট মাস বয়সী সাদমান। একদিন যাবত সাদমানের বাবার দাবি, তিনিসহ তার পরিবারের সবাই কলেরার টিকা খেয়েছেন। তবুও তার শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। পাশ থেকে শিশুটির দাদি বলেন, ‘টিকা খাইছি, বাচ্চাকেও খাওয়াইছি। এরপরেও হয়েছে, কি ওষুধ দেয় আল্লাহ জানে।’

এদিকে, একইদিনে নয় বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় অন্য রোগীর স্বজনরা। তবে একইদিন সকালে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ঠিক ডায়রিয়ার কারণেই মারা গেছে কিনা তা তারা বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। 

হাসপাতালে রোগীর চাপের বিষয়ে জানতে চাইলে জনসংযোগ শাখার সিনিয়র ম্যানেজার এ কে এম তারিফুল খান ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন আসলে ডায়রিয়া প্রকোপের মওসম শুরু হয়নি। এটি সাধারণত বর্ষার আগে আগে শুরু হয়। অর্থাৎ আরও এক থেকে দেড় মাস পর। তখন আমাদের এখানে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। আর আমাদের এখানে সংখ্যাটা একটু ভিন্নভাবে হিসেব করা হয়। কারণ অনেক রোগী কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে চলে যায়। তাদের নির্দিষ্ট সময় অবজারভেশনে রেখে, শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়া হয়। আমরা কতজন রোগী ভর্তি করছি তা হিসেব করা হয়। এসব রোগীদের কেউ কেউ একদিন-দুইদিন-পাঁচ দিন থাকে। আবার কেউ কেউ দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা থাকার পর ছাড়পত্র পেয়ে চলে যায়। এই হিসেবে বর্তমানে আমাদের এখানে কম-বেশি প্রায় ৪০০ রোগী ভর্তি আছেন। 

এটেনডেন্টের বিষয়ে কড়াকড়ি, স্বাজনদের হট্টগোল

সরজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের মূল ফটকের ভেতর হাসপাতাল ভবনে প্রবেশের আগে দড়ি দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নতুন রোগীদের প্রবেশের জন্য সামন্য খুলা স্থান রেখে দুইজন আনসার সদস্য তা পাহাড়া দিচ্ছেন। তাদেরকে ঘিরে ধরে আছে রোগীর স্বজনরা। তাদের দাবি, আনসার সদস্যরা তাদের রোগীর কাছে যেতে বাঁধা দিচ্ছে। এ নিয়ে সকলে হট্টোগোল করছেন।

হাসপাতালটিতে না আনলে রোগী ভালো হয় না বলে মন্তব্য করা জোবেদা খাতুনও তাদের একজন। তিনি বলেন, তারা নাবি অতিরিক্ত কোনো লোক সাথে থাকার জন্য দেবে না। রোগীর সাথে মাত্র একজন লোক থাকতে পারবে। আমার এখানে বাচ্চা দুইটা, তাহলে মানুষ দুইজন থাকা লাগে না? কিন্তু না তারা আমাকে ঢুকতে দেবে না। বলছে বাচ্চাদের মা ভেতরে আছে তাই আপনাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। 

অপর এক নারী বলেন, ‘আমি কাপড় শুকাতে দিয়েছিলাম, ওইগুলো আনতে বের হয়েছি এখন আর ঢুকতে দিচ্ছে না। আমার রোগী বাচ্চা শিশু, মা একা সামাল দিতে পারে না। এটা বলার পরেও ঢুকতে দেবেই না।’

এ বিষয়ে কর্তব্যরত আনসার সদস্যের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানকার নিয়ম হলো রোগীর সাথে একজন থাকবে। তাই তাদের ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ সবারই ভেতরে লোক আছে।’ 

প্রতিদিনই এমন করা হয় কিনা জানতে চাইলে অপর আনসার সদস্য বলেন, ‘একদিন করবো আরেকদিন করবো না এমন তো হবেনা। ভর্তির কাজ শেষ করার পর রোগীর সাথে শুধুমাত্র একজন থাকতে পারবে। যেমন বাচ্চার সাথে তার মা। বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রেও একজন সাথে থাকতে পারবে।’  

এ বিষয়ে তারিফ খান জানন, নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতারে একজন রোগীর সাথে একজন এটেনডেন্ট থাকবে। হাসপাতাল ইমিউনিটি কমপ্রোমাইজড অর্থাৎ যারা ইতিমধ্যে অসুস্থ তাদের জায়গা। এখানে বেশি লোক হওয়া মানে সংক্রমণ হওয়া সম্ভবনা বাড়া। সারাবিশ্বে কোথাও রোগীদের সাথে এত লোকজনকে এলাউ করে না। কলেরা হাসপাতালে নির্দিষ্ট ভিজিটিং আওয়ার আছে তখন স্বজনরা দেখা করতে পারেন। এছাড়া একজন রোগীর সাথে একজন এটেনডেন্ট থাকতে পারেন। এখন ২০০ রোগী থাকলে তাদের সাথে আরও ২০০ মিলিয়ে ৪০০ জন আছে। এর মধ্যে যদি আরও লোকজন থাকে তাহলে বিষয়টি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায় একজন রোগীর সাথে আরও অনেক মানুষ থাকে। এটা হওয়া তো উচিৎ না। 

এমএইচ/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর