শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নন্দিতা বড়ুয়ার মরণোত্তর দেহদান: চোখের আলো পেল দুই জন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

নন্দিতা বড়ুয়ার মরণোত্তর দেহদান: চোখের আলো পেল দুই জন

একটি মৃত্যু আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফেরাল দুইজন মানুষকে। এবার রাজধানী বাসাবো এলাকার বাসিন্দা নন্দিতা বড়ুয়ার (৬৯) মরণোত্তর কর্নিয়া দানে চোখের আলো ফিরে পেয়েছেন দুইজন ব্যক্তি। তারা হলেন— কাওখালি কলেজের ব্যবস্থাপনার বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস (২৩) ও পটুয়াখালীর দলিল লেখক আব্দুল আজিজ (৫০)।

বৃহস্পতিবার (০২ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এনাটমি বিভাগের পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ নন্দিয়া বড়ুয়ার মরণোত্তর দেহগ্রহণকালে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। 


বিজ্ঞাপন


অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, নন্দিতা বড়ুয়ার এই ধরণের মহৎ উদ্যোগের প্রশংসা করি। মরণোত্তর দেহদানকারীর দুই কন্যা শাপলা বড়ুয়া এবং সেজুতি বড়ুয়াসহ পরিবারের সকলকে এই ত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। দেশের প্রথম ক্যাডাভেরিক অঙ্গদাতা হিসেবে সারা ইসলাম বাংলাদেশের মানবকল্যাণে দেহদানে ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবেন। সারার পথ অনুসরণ করে আজকে অনেকেই ক্যাডাভেরিক অঙ্গদান ও মরণোত্তর দেহদানের আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন। আজকে নন্দিতা বড়ুয়ার অবদান মানব জাতি মনে রাখবে। নন্দিতা বড়ুয়ার কর্নিয়ার নতুন করে চোখের আলো ফিরে পেয়েছেন আরও দুইজন।’ 

গত একমাসে মরণোত্তর চক্ষু দান প্রক্রিয়ায় ১২ জনের চোখে সফলভাবে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং কর্নিয়াগ্রহীতার বেশ ভালো আছেন জানিয়ে দেশের সকল মানুষের প্রতি এই রকম মহতী কাজে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান বিএসএমএইউ উপাচার্য।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে বেগবান করা হয়েছে। গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে নানান উদ্যোগ নিচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণার কাজে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করার একটি প্রয়াস হলো এই মরণোত্তর দেহদান।

অনুষ্ঠানে নন্দিতা বড়ুয়ার মরদেহটি বিএসএমএমইউর এনাটমি বিভাগে সংরক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহারের আবেদনপত্রটি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের নিকট প্রদান করা হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদের অনুমতিতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি এনাটমি বিভাগের প্ল্যাস্টিনেশন ল্যাব অ্যান্ড মিউজিয়াম কমপ্লেক্সে সম্পন্ন করা হয়। মরদেহের এমবামিং প্রক্রিয়ার শুরুতে এনাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লায়লা আনজুমান বানুর পরিচালনায় এবং এনাটমি বিভাগের সকল শিক্ষক, কর্মচারী ও রেসিডেন্টদের অংশগ্রহণে মরদেহের যথোচিত সম্মান ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়।


বিজ্ঞাপন


অনুষ্ঠানে নন্দিতা বড়ুয়ার দুই মেয়ে শাপলা বড়ুয়া এবং সেজুতি বড়ুয়াও মরণোত্তর দেহদানের ইচ্ছা পোষণ করেন।

এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ, সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন, এনাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লায়লা আনজুমান বানু, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শাহ আলম, উপচার্যের একান্ত সচিব-১ সহযোগী অধ্যাপক (সার্জিক্যাল অনকোলজি) ডা. মো. রাসেল, হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার (টিটো), কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শীষ রহমান, কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজশ্রী দাস, এনাটমি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শারমিন আক্তার সুমি, নন্দিতা বড়ুয়ার কর্নিয়া গ্রহীতা জান্নাতুল ফেরদৌস ও আব্দুল আজিজ প্রমুখ।

এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি রাত ২টা ৩০ মিনিটে বিএসএমএমইউর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৯ বছর বয়সী নন্দিতা বড়ুয়া মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনিজনিত জটিল রোগে ভুগছিলেন। কিডনি রোগের পাশাপাশি তিনি এসএলই ও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশাতেই মরণোত্তর দেহদানের ব্যাপারে সন্তানদের কাছে নিজের ইচ্ছেপোষণ করে গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুবরণ করার পর পরিবারের সম্মতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্নিয়া বিশেষজ্ঞরা মৃতের কর্নিয়া সংগ্রহ করেন।

পরে গত ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শীষ রহমান পটুয়াখালীর দশমিনা সাব-রেজ্রিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক আব্দুল আজিজের চোখে ও অপথালমোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজশ্রী দাস ঝালকাটি জেলার কাওখালি কলেজের ব্যবস্থাপনার বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌসির চোখে একটি করে কর্নিয়া সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেন।  

উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালের ২ জুন চট্টগ্রামের পটিয়ার কোলাগাঁও গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে নন্দিতা বড়ুয়ার জন্ম হয়। তার মা সন্ধ্যারানী বড়ুয়া ও বাবা রাজকৃষ্ণ বড়ুয়া। বাবা ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি কলকাতা আশুতোষ কলেজে পড়াকালীন কংগ্রেসের সাথে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এই পরিবারেই অত্যন্ত স্নেহে ও আদরে বেড়ে উঠেছিলেন নন্দিতা বড়ুয়া। ৬ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। স্বামী বাবুল প্রসাদ বড়ুয়া ছিলেন বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। স্বামীর কর্মস্থল দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে হওয়ায় সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি ঢাকায় থিতু হন। এরই মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। সন্তানদের মানুষ করার স্বপ্ন নিয়ে নিজের আজীবনের সঞ্চিত অর্থ থেকে ঢাকায় এক খন্ড জমি কিনে বাড়ি করেন। তিনি যখন এলাকায় বাড়ির কাজ ধরেন তখন সেখানে রাস্তা, গ্যাস, পানি বা বিদ্যুৎ কিছুই ছিল না। এলাকার উন্নয়নের কথা ভেবে অনেক পরিশ্রম করে নিজ উদ্যোগে সমস্ত কিছু আনেন। কিন্তু স্বামী চাকরি সূত্রে দূরে থাকায় সারাটি জীবন তাকে একাই সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে, দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে সন্তানদের মানুষ করার গুরু দায়িত্ব নিজেকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মেয়ে শাপলা বড়ুয়া একজন আইনজীবী, সেঁজুতি বড়ুয়া কবি ও সাহিত্যিক।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর