বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস: সেবা বাড়বে কি?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:১৯ এএম

শেয়ার করুন:

সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস: সেবা বাড়বে কি?

সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে দেশবাসীর নানা অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক না পাওয়া এবং বেসরকারি হাসপাতালে সেবার উচ্চমূল্যের অভিযোগ সবচেয়ে আলোচিত। এ অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে ডিউটি শেষে সেখানেই চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে চিকিৎসকরা নিজ হাসপাতালেই চেম্বার পরিচালনা করবেন। এই কার্যক্রমকে ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস বলা হচ্ছে।

গত ২২ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই ঘোষণা দেন। শুরুতে ১ মার্চ ২০টি জেলা ও ৫০টি উপজেলা হাসপাতালে পরীক্ষামূলকভাবে এই সেবা চালু হবে। এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবায় আমূল পরিবর্তন আনবে বলে আশা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এদিকে এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেব দেখলেও এর সাফল্য পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া এই ধরনের উদ্যোগ ফ্লপ হওয়ার শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা।


বিজ্ঞাপন


যে প্রক্রিয়ায় চলবে ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণত দুই প্রক্রিয়ায় সেবা প্রদান করা হয়। একটি জরুরি রোগীদের জন্য অন্তঃবিভাগ সেবা এবং বহির্বিভাগে রোগীদের স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদান। সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকরা সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। পরে বেশিরভাগ চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখেন।

ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসের আওতায় সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখা শেষে বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, এই কাজটি শুরু করতে দ্রুত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। দেশের মানুষের জন্য এটি মার্চ মাসে শুরু হবে। এটি শুরু হলে দেশের লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন ক্লিনিক, ফার্মেসিতে চিকিৎসক দেখানোর ভোগান্তি থেকে রেহাই পাবেন।

rogi


বিজ্ঞাপন


একইসঙ্গে চিকিৎসকরা হাসপাতালে অবস্থান করায় জরুরি প্রয়োজনে ওয়ার্ডে গিয়েও রোগীকে সেবা দিতে পারবেন বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

কি ভাবছেন সেবা সংশ্লিষ্টরা?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, এটি অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ। এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। তবে এটি কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ এ ধরনের ভালো কাজের জন্য কিছু অবকাঠামো প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালগুলোতে পোস্ট খালি, পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নেই। পরীক্ষার জন্য এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, ল্যাবরেটরি সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় যে সেবাটি চালু করবেন তাতে ভবিষ্যতে যেন ঝামেলা না হয় সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. রেদওয়ান আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, একটা বড় সমস্যাকে পিসমিল বা টুকরো টুকরো সমাধানের মাধ্যমে সঠিক করা যায়। সাধারণভাবে ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসকে একটি পিসমিল সমাধান বলা যায়। পিসমিল সমাধানে সামগ্রিকভাবে তেমন কোনো উন্নয়ন হয় না। তবে এতে জনগণ সরকারি চিকিৎসক ও সেবার অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে বলে মনে করি। এর মাধ্যমে মানুষ সরকারি হাসপাতালমুখী হবে। এটি যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে নানাবিধ সুবিধাও পাওয়া যাবে। যেমন- একজন চিকিৎসক যদি হাসপাতালেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, তাহলে হঠাৎ করে হাসপাতালে কোনো জরুরি রোগী আসলে ওয়ার্ডে গিয়ে তা দেখতে পারবেন। ওভারঅল এটি একটি ভালো উদ্যোগ।

বর্তমান অবকাঠামোতে সুফল পাওয়া চ্যালেঞ্জিং

অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, যেকোনো হাসপাতালে গেলে দেখা যায়, আউটডোর রোগীতে সয়লাব। ডেস্কটা ছোট, মানুষ বেশি। রোগীর চাপে আউটডোরে ঢোকা যায় না। নতুন করে অবকাঠামো তৈরি না করে এরমধ্যে যদি আবার চেম্বার শুরু করেন, তাহলে তা কতটা সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। চেম্বার শুরু করলে জায়গার প্রয়োজন হবে। অন্তত রোগী ও রোগীর এটেনডেন্টদের বসার ব্যবস্থা তো করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, রোগী দেখার পাশাপাশি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ-সুবিধাও তো থাকতে হবে। বর্তমানে যা আছে তা দিয়ে তো বর্তমান রোগীদেরই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এরমধ্যে যদি আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করেন, তাহলে তো পারবেন না। সিটিস্ক্যান, এমআরআই, এক্সরে হয়তো দিনে ২০-৪০টা করা যায়। বিকেলে শুরু করলে তা আরও অনেক বাড়বে। মেশিনগুলো এই চাপ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। একইসঙ্গে এসব মেশিন চালানোর জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই। এখনই একটা সাধারণ আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়, দুই-তিনদিন ঘুরতে হয়। এর মধ্যে সেবার সংখ্যা বাড়ানো কি করে সম্ভব? আমি বলব, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে সবার আগে অবকাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।

rogi

স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে অধ্যাপক রেদওয়ান আহমেদ বলেন, এটা বাস্তবায়ন করা উচিৎ। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবায় অনেক কিছু রিফর্ম করা দরকার। কিন্তু আমরা তা করতে পারছি না। এ অবস্থায় রোগীদের সরকারি হাসপাতালমুখী করা এবং ডায়াগনোসিস কার্যক্রম একটিভ করে কিছু রেভেনিউ করা সম্ভব হয়, তাহলে এটাও স্বাস্থ্যখাতের জন্য উপকারী হবে। একইসঙ্গে বাইরে ভুয়া চিকিৎসকের দ্বারা মানুষ প্রতারিত হওয়ার যে সম্ভাবনা আছে তাও কমে যাবে। তবে হাসপাতালে যদি আবার দালাল শ্রেণি তৈরি হয়ে যায় তাহলে সেটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া এটি বর্তমান পদ্ধতির থেকে ভালো হবে।

বিএসএমএমইউ অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ

সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারে মতো এই উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও এটিই দেশে প্রথম নয়। দেশের সর্বোচ্চ মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ২০১১ সাল থেকে রোগীদের বৈকালিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের কর্মঘণ্টা শেষে ২৬টি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সপ্তাহে পাঁচদিন ২০০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখছেন। অর্থাৎ হাসপাতালের সাধারণ ডিউটি শেষে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উদ্বোধন করা সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালেও একই ধরনের সেবা বড় পরিসরে শুরু করা হয়েছে।

বিএসএমএমইউ দেশের অন্য যেকোনো হাসপাতালের তুলনায় অবকাঠামোগতভাবে উন্নত ও শৃঙ্খলিত। তবে হাসপাতালটির বৈকালিক সেবা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। হাসপাতালটিতে সরজমিনে দেখা যায়, সকালে বহির্বিভাগে যেমন রোগীর দীর্ঘ লাইন থাকে, বৈকালিক সেবা নেওয়ার সময়ও একই দীর্ঘ লাইন। এমনকি একাধিক রোগী একসঙ্গে চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশ করেন। ২০০ টাকা ভিজিট দিলেও ১০ টাকার টিকিটের রোগীদের তুলনায় কতটা উন্নতমানের সেবা পাচ্ছেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এ অবস্থায় বিএসএমএমইউর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রোগীর সন্তুষ্টির দিকে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, পরিপূর্ণ সেবা নিশ্চিতে যেখানে চিকিৎসকের ঘাটতি সেখানে চিকিৎসক দিতে হবে, স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি থাকলে স্বাস্থ্যকর্মী দিতে হবে। অর্থাৎ আগে জনবল ঘাটতি ও অবকাঠামো ঠিক করতে হবে। এরপর ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরু করলে তা অধিক ফলপ্রসু হবে। এছাড়া দেশে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞের পরিমাণ তো আরও কম। এ ধরনের উদ্যোগের পাশাপাশি ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে ভালো পরিকল্পনা যেন ফ্লপ না হয়ে যায়।

অধ্যাপক রেদওয়ান আহমেদ বলেন, সরকারের এ উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হবে কিনা তা পরিষ্কার নয়। তবে মানুষ হাসপাতালমুখী হবে, অপচিকিৎসা থেকে মুক্তি পাবে। স্বাস্থ্যসেবা বলতে আমি রোগীর সন্তুষ্টির কথা বোঝাচ্ছি। রোগীর সন্তুষ্টি এখানে হবে কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। পুরো স্বাস্থ্য খাতকেই ঢেলে সাজাতে হবে, নয়তো এভাবে স্বাস্থ্যেসেবার উন্নতি হবে না।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর