বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

করোনার ‘বিএফ.৭’ উপধরন: আমাদের প্রস্তুতি ও ঝুঁকি

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

করোনার ‘বিএফ.৭’ উপধরন: আমাদের প্রস্তুতি ও ঝুঁকি
করোনা পরীক্ষা করতে আসা একজন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন | ফাইল ছবি

প্রায় নিয়ন্ত্রণে থাকা করোনার স্বস্তিদায়ক পরিবেশে হঠাৎই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওমিক্রনের নতুন উপধরন ‘বিএফ.৭’। সর্বশেষ চীন থেকে আসা এক যাত্রীর শরীরে এর উপস্থিতি পাওয়ার পর করোনা নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে। জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে, সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

২০২২ সালের প্রায় পুরো সময় সারাবিশ্বে করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। আক্রান্ত ও সংক্রমণের দিক থেকেও সব দেশ স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিল। তবে ডিসেম্বরের শুরু থেকেই চীনসহ বেশ কিছু দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকে।


বিজ্ঞাপন


বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানায়, চীনে ডিসেম্বরের ২০ দিনে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এ জন্য বিএফ.৭ নামে নতুন উপধরনকে দায়ী করা হয়। একইসঙ্গে প্রতিবেশী ভারতেও সংক্রমণ বাড়ায় নড়ে চড়ে বসে বাংলাদেশ সরকার। করোনা সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির পরামর্শে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

coronavirusএরইমধ্যে গত ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আসা চার চীনা নাগরিকের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। পরে তাদের নমুনা পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠানো হলে, ১ জানুয়ারি একজনের বিএফ.৭ উপধরন শনাক্ত হয়।

এ অবস্থায় করোনাভাইরাস নিয়ে নতুন করে শঙ্কা ও ঝুঁকি দেখছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের সব ধরনের পরিস্থিতি প্রস্তুতি রয়েছে।

শঙ্কা দেখছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা


বিজ্ঞাপন


প্রখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, নতুন করে সংক্রমণ আমাদের জন্য মারাত্মক হতে পারে। বাংলাদেশ খুবই ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের যে টিকা দেওয়া আছে তা কতটা নিরাপত্তা দেবে তা বলা মুশকিল। চীনের মতো দেশ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারা করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ দিয়েও পরে তা তুলে নিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা যদি এখনই এটি প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ না নিতে পারি, তাহলে আমাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তিনটি ঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমত: আমাদের কিছু লোক একেবারেই টিকা পায়নি। এরা সাধারণত গ্রামের নিরক্ষর বয়স্ক লোক। তারা নানা কারণে টিকার আশপাশেও আসেনি। আবার খুব একটা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে তাও বলা যাবে না। এদেরকে খুঁজে বের করার বা টিকা নিতে মোটিভেট করার মতো কার্যক্রম ছিল না। দ্বিতীয়ত যারা প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছে তাদের বেশিরভাগ হয়তো দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছে। কিন্তু সেটা যে এখনও প্রটেকশন দিচ্ছে সেটা বলা মুশকিল। কারণ কারো কারো অনেক দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। করোনার অনেক টিকারই দীর্ঘ সময় ইমিউনিটি থাকছে না। ফলে তৃতীয়-চতুর্থ ডোজ দিতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, তৃতীয় ডোজ নেওয়ার বেশ কয়েক মাস পর অনেকের অ্যান্টিবডি কমে যাচ্ছে। তাহলে যারা দুই ডোজ নিয়েছে তাদের একটা বড় অংশ এখন ঝুঁকিপূর্ণ।

coronavirusবিএফ.৭ প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা নিয়ে অধ্যাপক বেনজির বলেন, করোনা বিষয়ক কারিগরি কমিটির কাজ হচ্ছে পরামর্শ দেওয়া। এটি দিয়ে আসলে কতটা বাস্তবায়ন হবে তা বলা মুশকিল। বাস্তবে দেখতে হবে যে কাজগুলো আমাদের করা দরকার তা আমরা করছি কিনা। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা কতটা কার্যকর তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আপনি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে ভাইরাসও আপনার মতো নিষ্ক্রিয় থাকবে, ছড়াবে না, সেটা তো বাস্তবসম্মত না। চীন থেকে আসা চারজনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট ঝুঁকি থাকায়, তাদের সাথে আসা সবাইকেই কোয়ারেন্টাইন করার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। তাদের অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হয়েছে। এটির সেনসিটিভিটি কম।

দেশে প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা দুর্বল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে আমাদের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ভালো, রোগীর মৃত্যুও কম। কিন্তু প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধের জায়গাটা দুর্বল। ফলে মৃত্যু কমানো গেলেও ভোগান্তিটা কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। আমরা খুব ভালো ব্যবস্থা নিয়েছি এটা দাবি করা মুশকিল। পরামর্শক কমিটিসহ যারা আছেন তাদের উপদেশগুলো গ্রহণ করে যদি ভালোভাবে পদক্ষেপ নেওয়া যায় তাহলে ক্ষতি নেই। আমাদের হয়তো কিছু ইনভেস্টমেন্ট করতে হয়। এতে তো কোনো ক্ষতি নেই।

coronavirusএদিকে সচেতনতা বৃদ্ধি ও টিকা কার্যক্রমের উপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এমিরিটস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। আমাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি একদম নাই হয়ে গেছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরিধান করতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক দূরত্ব যতটা সম্ভব মেনে চলতে হবে। মানুষ তো এখন একদম ভয়ই পায় না। এছাড়া যারা টিকা নেয়নি তাদের সবার তা নিতে হবে। এখন সরকার দ্বিতীয় বুস্টার কার্যক্রম চালু করেছে। যারা প্রথমটা নেয়নি তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ে নিতে হবে।

আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ

করোনার নতুন ধরনের বিষয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, এটি খুব বেশি ক্ষতিকারক নয়, ভয়ানকও নয়। এর সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। এই ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে মৃত্যুর হার বেশি নয়। তবে এই ভ্যারিয়েন্ট যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য কাজ চলছে। এয়ারপোর্ট, সি-পোর্ট ও ল্যান্ডপোর্টে টেস্ট করানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলোকেও প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

একই পরামর্শ দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে পরিস্থিতি কী হবে সেটা পারিপার্শ্বিকতা এবং আমাদের প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করবে। যদি নতুন করে রোগী বাড়ে এবং অনেক সংখ্যায় হয় তাহলে সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা চাই না এমন কিছু হোক। আমাদের করোনা সংক্রমণের হার এক শতাংশের নিচে আছে। আমরা কাউকে আতঙ্কিত করতে চাই না। সতর্ক থাকলে করোনা পরিস্থিতি নাগালের বাইরে যাবে না। মাস্ক পরাসহ সাধারণ কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে।

coronavirusকারিগরি কমিটির পরামর্শগুলো বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে নতুন করে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটি আমাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছে। আমরা তা ফলো করছি। দেশের প্রবেশপথগুলোতে সন্দেহভাজন রোগীদের স্ক্রিনিং ও করোনা শনাক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রবেশপথেই স্ক্রিনিং করে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা গেলে ছড়ানোর আশঙ্কাটা থাকছে না। হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সন্দেহভাজন সব রোগীকে পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

করোনা টিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম পুরোদমে চলমান আছে। বর্তমানে চতুর্থ ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা চাইব সবাই যেন করোনার তৃতীয় ডোজ নিয়ে নেয়। যারা চতুর্থ ডোজ পাওয়ার জন্য যোগ্য তারা যেন তা নিয়ে নেয়।

এমএইচ/জেএম/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর