বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

দশ টাকায় বিশেষজ্ঞ: অভিযোগ থাকলেও সন্তুষ্টি সেবাপ্রত্যাশীদের

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

দশ টাকায় বিশেষজ্ঞ: অভিযোগ থাকলেও সন্তুষ্টি সেবাপ্রত্যাশীদের

বেলা ১১টা, রাজধানীর তেজগাঁওয়ের জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউটের সামনের টং দোকানে বসে চা খাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব রহিমা খাতুন। কানের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের বাহির্বিভাগে ১০ টাকার টিকিট কেটে নিজের সিরিয়ালের অপেক্ষায় আছেন তিনি। এটিই তার প্রথমবার নয়, আগেও চার থেকে পাঁচবার এখানে এসেছেন এই নারী। সিরিয়াল দিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে বাইরে বসে চা খাওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টিকিট কাটার পর কম্পিউটারে ডাকে, তাই লাইন ধরে দাঁড়াতে হয় না। নম্বর অনুযায়ী ডাকলে ভেতরে যাই।’

রাহিমা খাতুনের মতো আরও অসংখ্য মানুষ টিকিট কেটে অপেক্ষা করছেন তার সিরিয়ালের জন্য। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটির নিচতলায় রোগীদের এই চাপ লক্ষ্য করা যায়। রাহিমাসহ সেবা নিতে আসা একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এছাড়া জরুরি ও আন্তঃবিভাগের সেবা প্রত্যাশীদের নানা সুবিধা-অসুবিধা নিয়েও কথা হয় একাধিক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। 


বিজ্ঞাপন


সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে রহিমা খাতুন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার বাসা হাসপাতালের পাশেই। আমি এর আগে আরও চার-পাঁচবার এই হাসপাতালে এসেছি। আমার কানে সমস্যা, কম শুনি। প্রতিবারই ডাক্তার দেখে ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হইনি। সবশেষ কানের মেশিন দিয়েছে। প্রথম কয়েকদিন ঠিক থাকলেও এখন ‘শশ শশ’ আওয়াজ করে। কিছুই শুনি না, এই কারণে আবার এসেছি।’

মগবাজার থেকে বহির্বিভাগে আসা কলেজ শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘শীতের শুরুর পর থেকেই গলায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। গলা ব্যথা করে, ঝাল বা মসলাজাতীয় খাবার খেলেই জ্বালাপোড়া হয়। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি। এর আগেও এখানে সেবা নিয়েছি। আমার নাক থেকে রক্ত পড়ার সমস্যা ছিল। ডাক্তার ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি বাসার বাইরে মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। বর্তমানে ওই সমস্যা নেই।’

সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে উভয়ই এই প্রতিবেদককে জানান, প্রতিষ্ঠানটির বহির্বিভাগ অনেক শৃঙ্খলিত। টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। সিরিয়াল অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য রুমে ডাকেন। ফলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। হাসপাতালের পক্ষ থেকে পরামর্শের পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয় বলেও জানান তারা। তবে সেবার বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্যের পাশাপাশি অভিযোগও রয়েছে অনেক সেবাপ্রত্যাশীর। বেশ কয়েকজন অভিযোগ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও তারা চিকিৎসক পাচ্ছেন না। দায়িত্বরত ব্যক্তি তাদের জানিয়েছেন, ‘চিকিৎসক জরুরি বিভাগ বা সার্জারিতে আছেন। তাদের অপেক্ষা করতে হবে।’ 

সেবার বিষয়ে যা বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
বাহির্বিভাগের সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু হানিফ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিদিন ৬০০ জনের অধিক রোগী আউটডোরে সেবা নেয়। মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে রোগীরা সকল ধরনের সেবা পেয়ে থাকেন। দশ টাকার মধ্যে প্রাথমিক অবস্থায় কনসালটেশন দেওয়া হয়। আমাদের এখানে কয়েকধাপে রোগীদের পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রথমে একজন চিকিৎসক দেখেন, যদি তিনি এটিকে জটিল কেস মনে করেন তাহলে তারা দ্বিতীয় পর্যায়ে সিনিয়র কারও কাছে পাঠিয়ে দেন। তারপর প্রয়োজনে সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দেখেন। সর্বশেষ আমার কাছেও আসেন। জুনিয়র থেকে ধাপে ধাপে সিনিয়রদের কাছে রোগীদের পাঠানো হয়। অর্থাৎ ১০ টাকার বিনিময়ে রোগী তিন ধাপে কনসালটেশন পেয়ে থাকেন।’


বিজ্ঞাপন


dm

সেবার পরিধির তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে সকল খরচ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মাধ্যমে সরকার দিয়ে থাকে। এই হাসপাতাল চালাতে গিয়ে গত তিন বছরে বরাদ্দকৃত টাকা থেকে ৪৮ কোটি টাকা সরকারকে ফেরত দিয়েছি। অর্থাৎ আমাদের বরাদ্দে কোনো ঘাটতি নেই। ফলে যতটা সম্ভব রোগীর প্রয়োজনীয় সকল উপাদান আমরা দিচ্ছি। এর মধ্য থেকেই আমরা রোগীদের আউটডোরে বিনামূল্যে ওষুধ প্রদানের কাজও করে থাকি। এখানে আমরা এন্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে কানের ড্রপসহ যা যা প্রয়োজন সবই বিনামূল্যে দিচ্ছি।’

‘বহির্বিভাগ থেকে কোনো রোগী যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন তার হাসপাতালে থাকা, খাওয়া, ওষুধ থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচারে যা খরচ তার সম্পূর্ণটাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করে। তার অস্ত্রোপচারের খরচ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, এনেস্থেশিয়া, এন্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে সকল প্রয়োজনীয় উপাদান রোগীরা নামমাত্রা মূল্যে হাসপাতাল থেকে পেয়ে থাকেন,’ যোগ করেন অধ্যাপক হানিফ।

সার্জারির খরচের বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে গত তিন-চার বছরে ৩২৫ জনের মতো রোগীকে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট (বধির শিশুদের কানে শুনার প্রক্রিয়া) করেছি। মাঝের দুই বছর করোনা থাকায় রোগীরা নিয়মিত আসতে পারেনি। তবুও আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টে স্থাপন করা একেকটি মেশিনের দাম ছয় থেকে সাত লাখ টাকা, সার্জারির খরচ আছে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। এর সবই আমরা নামমাত্র মূল্যে করে থাকি। এর জন্য সরকার নির্ধারিত কিছু ফি রয়েছে। ব্যক্তি বিশেষে এসব রোগীদের চার থেকে পাঁচ-ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরবর্তী ফলোআপ ও থেরাপি সেশনসহ বিভিন্ন সেবা রয়েছে যা আমরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দিচ্ছি।’

অন্তঃবিভাগে সিট পেতে বিড়ম্বনা
হাসপাতালের বাহির্বিভাগে সেবা পাওয়ার মতো অন্তঃবিভাগের সেবা পাওয়ার বিষয়েও প্রতিবেদকের কাছে অনেকটাই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন রোগীর স্বজনরা। বিশেষ করে হাসপাতালটির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কথা জানিয়েছেন তারা। তবে এসবের পাশাপাশি সিট না পাওয়া, তদবিরে প্রয়োজনীয়তাসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে রোগীর স্বজনদের। 

এমনই একজন গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে ভাইকে নিয়ে হাসপাতালটিকে আসা জালাল উদ্দিন (ছদ্মনাম)। সিট পেতে নিজের ভোগন্তির কথা জানিয়ে  তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের জিহ্বায় ক্যানসার ধরা পড়েছে। আমারা প্রথমে একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের অধীনে বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। চিকিৎসক অপারেশন করানোর কথা বলেছিলেন। তবে এতে অপারেশন থিয়েটার বাবদ ৫০ হাজার টাকা, চিকিৎসক ও অন্যান্য ব্যক্তিদের ফি এবং অনুসঙ্গিক খরচ বাবদ আরও দেড় লাখ টাকা লাগবে বলেন জানায়। হঠাৎ করে এত টাকার ব্যবস্থা করাসহ বেশ কিছু বিষয়ে চিন্তা করে আমরা পিজিতে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) যাই। সেখানকার ডাক্তার জানায়, এ ধরনের অপারেশনের জন্য নাক-কান-গলা হাসপাতাল ভালো হবে। তাই এখানে আসা। তবে এই হাসপাতালে সিট পেতে সমস্যা হয়েছে। কয়েকদিন ঘুরেও সিট পাইনি, পরে লাইন-ঘাট (তদবির) করে একটা সিট পেয়েছি। তারপর আরও তদবির করে একটা কেবিন পেয়েছি। এখন অপারেশনের অপেক্ষায় আছি।’

dm

এ অবস্থায় হাসপাতালটিতে সিট সংকট রয়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বলেন, ‘আমাদের এটি রেফারেল ভিত্তিক স্পেশালাইজড হাসপাতাল। ভর্তি রোগীদের একটা বড় অংশ অন্যান্য হাসপাতাল থেকে রেফারে আমাদের এখানে আসেন। একজন রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা তাকে ছাড়তে চাই না। ফলে সারাদেশ থেকে এখানে জটিল রোগীরা আসেন। তাদের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীও রয়েছে। তাদের অনেকের একেকটা অস্ত্রোপচার করতে ১০ ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। এখানে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টও করা হয়। প্রতিটা ককলিয়ার অপারেশন করতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। এই লম্বা অপারেশনে চিকিৎসকদের সময় দিতে হয়। হাসপাতালে জটিল রোগীদের অপারেশনের আগে পরে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়। এ জন্য আমাদের সিট খালি হতে সময় লাগে। আবার এসব অপারেশন দেশের অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে খুব একটা হয় না। ফলে সব সময় আমাদের এখানে রোগীদের চাপ থাকে।’ 

সিট স্বল্পতার কথা স্বীকার করে অধ্যাপক হানিফ বলেন, ‘আমাদের সিটের সল্পতার জন্য এই সমস্যাগুলো হয়। যেই হাসপাতালের সুনাম হবে, সেই হাসপাতালে রোগীও বাড়বে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তাই অন্তঃবিভাগে রোগীদের সিট পেতে কিছুটা বেগ পেতে হয়। এই সমস্যা সামাধানে আমরা ১২তলা ভবন করার উদ্যোগ নিয়েছি। এর কাজ চলমান রয়েছে। এটি হয়ে গেলে এই সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করি।’   

জনবল ঘাটতি রয়েছে
ইনস্টিটিউটটির জনবল ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসক ও সেবাকর্মী ঘাটতি আছে। এখানে অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদটি অনেকদিন যাবত খালি রয়েছে। রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগেও সহযোগী অধ্যাপক নেই। এছাড়া অন্যান্য বিভাগেও মেডিকেল অফিসারসহ বিভিন্ন পদে লোকবল ঘাটতি রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যেও আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। নাই বলে কাজ বন্ধ রাখার তো সুযোগ নেই। ফলে সেবা চালু রাখতে আমাদের অতিরিক্ত চাপ নিতে হচ্ছে।’ 

ঘাটতি পূরণে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত চিঠিপত্রের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সংকটের ব্যাপারে জানাচ্ছি। মন্ত্রণালয় আমাদের আন্তরিকভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। তবে লোক না থাকলে কোথা থেকে দেবে! দেশে অ্যানেস্থেসিওলজি, রেডিওথেরাপির মতো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জনবল আসলেই কম। আর এই পদগুলোতে চাইলেই লোক তৈরি করা যায় না, এটি কয়েকদিনের বিষয় না। এসব বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ তৈরি হতে লম্বা সময় লাগে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।’

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর