শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

প্রাণঘাতী হৃদরোগ: সর্বাধিক মৃত্যু হলেও নেই পর্যাপ্ত সচেতনতা

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:১৩ এএম

শেয়ার করুন:

প্রাণঘাতী হৃদরোগ: সর্বাধিক মৃত্যু হলেও নেই পর্যাপ্ত সচেতনতা

মাহামারী করোনায় মৃত্যুর মিছিল থামাতে সারাবিশ্ব একট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ফলশ্রুতিতে স্বল্প সময়েই নিয়ন্ত্রণে এসেছে করোনা। উন্নত বিশ্বের শহর থেকে তৃতীয় বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তৈরি হয়েছে সচেতনতা। অথচ করোনায় মোট মৃত্যু প্রতি বছরে হৃদরোগের কারণে হওয়া মৃত্যুর তুলনায় নগণ্য বলা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার তথ্য মতে, সারাবিশ্বে প্রতিবছর মোট মৃত্যুর সব থেকে বেশি মৃত্যু হয় হৃদরোগের কারণে। তবে এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতার যথেষ্টই ঘাটতি রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই হৃদরোগ ও এর প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতন নয়। ফলে হৃদরোগ ক্রমেই ভায়বহ প্রাণঘাতীতে রূপ নিচ্ছে। সবথেকে আতঙ্কের বিষয়, বয়স্কদের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। 


বিজ্ঞাপন


হৃদরোগ বলতে সাধারণ ভাবে হার্ট এ্যাটাকের চিত্র আমাদের চোখে ভেসে উঠলেও এর পরিধি অনেক দীর্ঘ। সাধারণ ভাবে হার্ট সংক্রান্ত যেকোন অসুখকেই হৃদরোগ বলা হয়ে থাকে। যেমন করোনারি হৃদরোগ, কার্ডিও মায়োপ্যাথি, উচ্চ রক্ত চাপ জনিত হৃদরোগ, হার্ট ফেইলিওর, হৃদপিণ্ডের ডান পাশ অচল হয়ে যাওয়া, শ্বাস প্রশ্বাস ব্যহত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি হার্টের অসুখের মধ্যে পড়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ মারা যায়। এর শতকরা ৮০ শতাংশই মারা যায় হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোকে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে হৃদরোগে। বর্তমানে দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ ভাগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। এর ৩৬ দশমিক ১ শতাংশই হৃদরোগী।

heart-disease

গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক ও তামাকজাত পণ্য।


বিজ্ঞাপন


গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায় এবং বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে যা হৃদরোগ পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে।

এ অবস্থায় হৃদরোগের বিষয়ে সারাদেশে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। মানব নিয়ন্ত্রিত সম্ভাব্য হৃদরোগের কারণগুলো শনাক্ত করে সচেতনা তৈরির মাধ্যমে প্রাণঘাতী এ রোগ অনেকাংশেই প্রতিরোধ সম্ভব বলে মানে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা, ওষুধের প্রাপ্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে হৃদরোগে মৃত্যুর রাশ টেনে ধরা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা।

heart-disease

প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, ‘সারাবিশ্বে মৃত্যুর এক নম্বর কারণ হৃদরোগ। বাংলাদেশেও মৃত্যুর প্রধানতম কারণ হৃদরোগ। আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি। এটি আগে ছিল না তা নয়, ছিল কিন্তু মানুষ জানতো না। সবাই মনে করতো এ রোগ শুধু ধনী মানুষের হয়। এখন দেখা যায় গরীব মনুষেরই বেশি হৃদরোগ হয়। এখন মানুষ আগের থেকে সচেতন হওয়ায় জানতে পারছে। আগে চিকিৎসক, পরীক্ষা ও ওষুধের ঘাটতি ছিল। এখন আমেরিকায় যে ওষুধ বা চিকিৎসা পাওয়া যায়, আমাদের এখানেও তাই পাওয়া যায়। আগে আমাদের বলা হতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মাত্র ৫ ভাগ রোগ ধরতে পারেন। এখন তা প্রায় শতভাগে উন্নিত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টাতেই তা ধরা পড়ে।

প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, হৃদরোগের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ঝুঁকি আছে যা আমরা চাইলেই প্রতিরোধ করতে পারি। যেমন: ধূমপান, সাদাপাতা, জর্দা ব্যবহারে হৃদরোগের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। এগুলো আমরা চাইলে পরিহার করে প্রতিরোধ করতে পরি। একইসঙ্গে কায়িক পরিশ্রম, ব্যায়াম, হাঁটা, সাঁতার কাটার মতো কাজগুলো কম করায় ঝুঁকি বাড়ে। একইসঙ্গে খাদ্যে কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার খাওয়া অন্যতম প্রধান ঝুঁকি। আবার কিছু ঝুঁকি আমরা চাইলেও প্রতিরোধ করতে পারি না কিন্তু ওষুধ খাওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যেমন: অল্প বয়সে অনেকের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ হয়। অনেকের পরিবারে অতীতে হৃদরোগের ইতিহাস থাকে। এগুলো প্রতিরোধ করা কষ্টকর কিন্তু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা ঝুঁকি কমাতে পারি। এখানে সমস্যাটি হলো, সকল রোগী সময়মতো আসেন না। যাদের পরিবারে রোগের ইতিহাস আছে তারা যদি ৪০ বছরে অন্তত একবার চেক করে, তাদের রোগের বিষয়ে আগে জানতে পারে তাহলে রোগগুলো আগে ধরা পড়ে। তাদের চিকিৎসা করাটা সহজ হয়।

‘হৃদরোগ প্রতিরোধই উত্তম। ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হৃদরোগ একবার মানেই সারাজীবনের রোগ। তাই প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে। আমরা ভাত, শর্করা জাতীয় খাবার, কোল্ড ড্রিংকস, অতিরিক্ত লবণ, সরাসরি চিনি জাতীয় খাবার না খেতে বলি। এর সাথে ক্যালরি হিসেব করে যতটা সম্ভব খাওয়া যায় তার চেষ্টা করতে হবে,’ যোগ করেন অধ্যাপক মোস্তফা জামান।

চিকিৎসা জোরদার ও বিকেন্দ্রিকরণ জরুরি
হৃদরোগীদের দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন জানিয়ে ডা. মোস্তফা জামান বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য সেবার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। আমাদের এখানে যখন কোনো হার্টের রোগী আসে, আমরা দ্রুততার সাথে তার এনজিওগ্রাম করি। প্রয়োজনে হার্টের ব্লকে রিং বসিয়ে দেই। আমরা বলি কেউ যদি সময় মতো চিকিৎসা করে তাহলে তার হার্ট দুর্বল হবে না। সে একদম তরুণদের মতো সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু সে চিকিৎসা মফস্বল এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। সকল চিকিৎসার ব্যবস্থা ঢাকায়। ফলে বাইরের একজন রোগীকে ঢাকায় আনতে ৫ থেকে ১২ ঘণ্টা লেগে যায়। এতে তার ক্ষতি হয়। এজন্য আমরা সেবার বিকেন্দ্রীকরণ চাই। খুলনার কেউ আক্রান্ত হলে সেখানেই তার চিকিৎসা হবে। প্রয়োজনে আমার ঢাকা থেকে স্থানীয় চিকিৎসককে পরামর্শ দেব। কার জন্য কি চিকিৎসা লাগবে সেটা বলে দেব। স্বাস্থ্য অধিদফতরকে আমরা এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা দিয়েছি। কার্ডিও ভাস্কুলার ডিজিজ সোসাইটির সভাপতি হিসেবে স্বাস্থ্যের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছি। আমরা বারবার স্বাস্থ্যনীতিতে হৃদরোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিশদ গাইডলাইন প্রণয়নের জন্য বলেছি।

heart-disease

এ সময় স্বাস্থ্য বাতায়নের মতো সেবাগুলোকে বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে হৃদরোগের মতো জরুরি প্রয়োজনে রোগীরা কোথায় যাবে সেই বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বলেন এই প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ।

বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হৃদরোগ মোকাবিলায় আমাদের তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো আমাদের দেশের মানুষ জানে না হৃদরোগ কেন হচ্ছে। কিভাবে প্রতিরোধ করতে হবে, কি খেলে বা কোন প্রক্রিয়ার হৃদরোগ হয়। দ্বিতীয়ত হাসপাতাল পর্যায়ে চিকিৎসার দরকার তা সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না। এর কারণ ধনী যারা আছে তারা চিকিৎসা নিচ্ছে, প্রয়োজনে বাইপাস করছে, রিং বসাচ্ছে কিন্তু আমাদের সাধারণ জনগণ তা করতে পারছে না। কারণ এই চিকিৎসাগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ অবস্থায় সরকার চাইলে এসেনশিয়াল ড্রাগের মাধ্যমে হৃদরোগের ওষুধগুলো বিনামূল্যে দিতে পারে। এতে রোগীরা অনেক উপকৃত হবে। হার্টের রিং দেশে উৎপাদন করা সম্ভব। তাহলে খুবই অল্প খরচে আমরা রোগীদের রিং বসাতে পারব। ইনস্টলমেন্ট সিস্টেম চালু করা উচিত। তাহলে ধনী-গরিব সবাই একই ধরনের চিকিৎসা সেবা পাবে। যেমন এখন ধনীরা প্রয়োজনে রিং বসাতে পারছে যা দরিদ্র রোগীরা পারছে না। বাইপাসের প্রয়োজন পড়লেও তারা তা পারছে না। এসব উদ্যোগ নিলে এই বিভেদটা থাকবে না।

তরুণদের আক্রান্ত হওয়া আশঙ্কাজনক
তরুণদের হৃদরোগের আক্রান্ত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, এক সময় বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগ বেশি রোগী দেখা যেতো। এখন তা ব্যাপকভাবে তরুণদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে ৩৫ বছরের কমবয়সী রোগীর সংখ্যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় ১৭ গুণ বেশি। এর কারণ অল্প বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া, অধিক হারে ধূমপান, শর্করা জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণ করা, কায়িক পরিশ্রম একেবারেই না করা। এছাড়া অল্প বয়সী অনেকের রক্তেও কোলেস্টরল রয়েছে। এছাড়া আমাদের উচ্চতা কম, ফলে আমাদের রক্তনালীর ধমনি অন্য দেশের তুলনায় চিকন থাকে। অর্থাৎ উচ্চতার সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে হৃদরোগে এবং যার অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তরুণদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার সর্বাধিক। তাই তাদের হৃদরোগ প্রতিরোধে তামাকের ব্যবহার কমানোর বিকল্প নেই।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর