বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হৃদরোগ চিকিৎসায় নব দিগন্তের সূচনা

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২৬ আগস্ট ২০২২, ০৯:৪০ এএম

শেয়ার করুন:

হৃদরোগ চিকিৎসায় নব দিগন্তের সূচনা

আশি বছর বয়সী আব্দুর রহমান (ছদ্মনাম), দীর্ঘদিন হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার হার্টের অ্যাওরটিক ভালভ সরু হয়ে যাওয়ায় নানা জটিলতা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও করোনাকালে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। মাহামারিকালে সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে না পারায় অবস্থার অবনতি হয়। এরই মধ্যে দুই দফা করোনায় আক্রান্ত হয়ে তার স্থান হয় হাসপাতালের বেডে। ফলে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়ে। তবে তার বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় সার্জারি করতে অপরাগতা জানান চিকিৎসকরা।  

এ অবস্থায় চিকিৎসকরা বুক না কেটেই তার ভালভ প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামানের নেতৃত্বে প্রথমবারের সফলভাবে বুক না কেটে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয় তার। এ সময় তাকে অজ্ঞানও করা হয়নি। কোনো প্রকার কাটা ছেড়া ছাড়াই হার্টের এনজিওগ্রমের মতো করে তার অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করেন চিকিৎসকরা।


বিজ্ঞাপন


বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথমবারের মতো সফলভাবে বুক না কেটে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয় ওই রোগীর। এ সময় তাকে অজ্ঞানও করা হয়নি। কোনো প্রকার কাটা ছেড়া ছাড়াই হার্টের এনজিওগ্রমের মতো করে তার অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করেন চিকিৎসকরা।

ভালভ প্রতিস্থাপনের পর রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল ছেড়েছেন। গত ২৪ আগস্ট তিনি হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে যান। বিএসএমএমইউর করোনারী ইউনিটে (সিসিইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ সেই রোগীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছেন। এ সময় তিনি পায়ে হেঁটে হাসপাতাল ছাড়েন।

bsmmu

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই রোগী ঢাকা মেইলকে বলেন, ভালভ প্রতিস্থাপনের আগে সব সময় বুকে ব্যথা থাকতো, ঘুমাতে পারতাম না। বিছানার এক কোনে বসে থাকতাম। ডাক্তাররা ওষুধ দেওয়ার পর কিছুটা ভালো লাগলেও পুরোপুরি ভালো হচ্ছিল না। এরপর এখানে প্রায় তিনমাস যাবত আছি। কয়েকদিন আগে অপারেশন হয়েছে। এরপর শরীর আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। আগে ঘুমাতে পারতাম না, এখন ঠিকমতো ঘুমাচ্ছি। খাওয়া-দাওয়ায় ঠিকমতো করতে পারছি। আগে শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল বোধ করতাম। এখন তা কমেছে, হাঁটাচলাও করতে পারছি।


বিজ্ঞাপন


রোগীর স্ত্রী বলেন, তিনি ২০১৭ সাল থেকে অসুস্থ। তার শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে সব সময় বসে থাকতেন, ঘুমাতে পারতেন না। এ আবস্থায় আমরা তাকে ঢাকায় নিয়ে আসছি। ডাক্তাররা তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে বলেছিল। তারা জানান যে, এ ধরনের অপারেশন বাংলাদেশে হয় না। তবে আমরা বাইরে নেইনি। ওষুধ দিয়েছিল, উনি ভালোই ছিলেন। তবে মাঝে তার দুইবার করোনা হয়। এরপরেই বেশি অসুস্থ হয়ে গেছেন। তখন থেকে তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।

বিএসএমএমইউতে চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা যখন অধ্যাপক মোস্তফা জামানের কাছে তাকে দেখালাম তখন তিনি বললেন, মেডিসিনে যতটা করার ছিল করা হয়েছে। এখন একটাই উপায় আছে, যার মাধ্যমে উনাকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এছাড়া বিকল্প আর কোনো পথ নাই। তখন আমরা রাজি হয়েছি। তারা কোনো কাঁট-ছেড়া করেনি। এভাবেই অপরেশনের পর উনি এখন সুস্থ। হাঁটাচলাসহ সবই স্বাভাবিকভাবে করতে পারছেন।

অধ্যাপক মোস্তফা জামানের কাছে তাকে দেখালাম তখন তিনি বললেন, মেডিসিনে যতটা করার ছিল করা হয়েছে। এখন একটাই উপায় আছে, যার মাধ্যমে উনাকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এছাড়া বিকল্প আর কোনো পথ নাই। তখন আমরা রাজি হয়েছি। তারা কোনো কাঁট-ছেড়া করেনি। এভাবেই অপরেশনের পর উনি এখন সুস্থ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ মাইলফলকের নেতৃত্ব দেওয়া চিকিৎসক অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, মানুষের হার্টে চারটি ভালভ থাকে। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভালভ হলো অ্যাওরটিক ভালব। এর মাধ্যমে বাম নিলয় থেকে রক্ত সারা শরীরে প্রবাহিত হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হার্টের ক্যালসিয়ামে তা ধীরে ধীরে সরু হয়ে যায়। তখন রক্ত চলাচলে বাঁধা তৈরি হয়। এতে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। যেমন রোগীর বুকে ব্যথা হতে পারে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। এ অবস্থায় তিনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। তার অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। গবেষণায় বলে সিভিয়ার অ্যাওরটিক স্টেনোসিস বা হর্টের ভালব সরু হয়ে গেলে রোগী দুই বছরের মধ্যে মারা যান। এটি ফুসফুস, প্রোস্টেট ক্যান্সারের মতো রোগগুলো থেকেও অধিক মারাত্মক।’ 

বুক না কেটে অপারেশন পদ্ধতি ও এটি করার কারণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বুক না কেটে হার্টের এনজিওগ্রাম যেভাবে করা হয় এক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে ভালভটি প্রতিস্থাপন করা হয়। রোগীর বয়স কম হলে আমরা সাধারণত বুক কেটে অপারেশন করি। কিন্তু বয়স্ক রোগীদের জন্য তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন এই রোগী সাম্প্রতিক সময়ে দুইবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাকে গত একমাস অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। তার অতীতে স্ট্রোক হয়েছে। তিনি কিডনিসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। তাই আমরা চিন্তা করলাম তাকে যদি ভালো করতে হয় তাহলে নতুন প্রক্রিয়াটি প্রয়োগ করতে হবে। যা সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো এ প্রক্রিয়াটি সফলতার সাথে ব্যবহার করেছি।

‘এটি করার আগে আমরা রোগীর পরিবারের সাথে কথা বলেছি। দীর্ঘ চিকিৎসার পর রোগী যখন কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। তখন তাকে আমরা অজ্ঞান না করেই, এনজিওগ্রামের মতো করে অপারেশনটি করেছি,’ যোগ করেন মোস্তফা জামান।

অত্যন্ত ব্যয়বহুল 

এ ধরনের চিকিৎসায় খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী এই অপারেশনের খরচ প্রায় ৫০ লাখ থেকে এককোটি টাকা। তবে আমাদের এখানে তা ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায় করা যায়। যদি সরকার আমাদের সহায়তা করে তবে ভবিষ্যতে তা আরও কম খরচে করা সম্ভব। এমনকি আমাদের দেশেও এই ভালভ উৎপাদন করা সম্ভব। তাহলে আমরা বিনামূল্যে এই চিকিৎসা করতে পারব। আমাদের কাছে থাকা তথ্যমতে এদেশে এই ধরনের রোগী প্রায় এক লাখ। কিন্তু ধনীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ এ চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন না। এর কারণ এর উচ্চ খরচ।’

ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা জনগণের নাগালের মধ্যে আনতে সরকারের সহায়তা চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অসচ্ছল জনগণ এ চিকিৎসা পান না। আমি বিশ্বের অন্যতম আধুনিক এই চিকিৎসা পদ্ধতি দেশের প্রতিষ্ঠা করতে চাই। দেশের অসচ্ছল মানুষেরা যেন এ সেবা নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা সরকার করে দিলে আমরা এ চিকিৎসা সেবাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারব।’

rogi

দেশ কী এটিই প্রথম?

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারাবিশ্বেই এটি একটি নতুন প্রক্রিয়া। দেশে এর আগেও এটি হয়েছে তবে সংখ্যাটি খুবই কম। কারণ এটি অত্যন্ত ব্যয় বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।’

উল্লেখ্য, গত ১৭ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। হাসপাতালটির সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের নেতৃত্বে একটি চিকিৎসক দল ৭৫ বছর বয়সী সাবেক এক সচিবকে সফলভাবে এই চিকিৎসা দেন। 

সাবেক ওই সচিব ২০১১ সালে হার্টের অ্যাওরটিক ভালভ সরু হওয়ার কারণে অন্য একটি হাসপাতালে বুক কেটে অ্যাওর্টিক ভালভ প্রতিস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পরে হাঁটার সময় তিনি শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। এ অবস্থায় তিনি ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের অধীনে ভর্তি হন। এরপর তার বুক না কেটে ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর