বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

প্রযুক্তি এগোলেও বাড়ছে স্তন ক্যানসার, সচেতনতায় কমতে পারে মৃত্যুঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

প্রযুক্তি এগোলেও বাড়ছে স্তন ক্যানসার, সচেতনতায় কমতে পারে মৃত্যুঝুঁকি
কোলাজ ঢাকা মেইল।

বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির মধ্যেও স্তন ক্যানসার নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হওয়া ক্যানসারের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সচেতনতার অভাব এবং প্রাথমিক লক্ষণ উপেক্ষার কারণে অনেক নারী দেরিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা রোগকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্ক্রিনিং, জেনেটিক পরীক্ষা এবং লক্ষ্যভিত্তিক থেরাপির ব্যবহার বেড়েছে, তবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে সব নারী সমান সুবিধা পাচ্ছেন না। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের নারীদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষা কম হওয়ায় রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএআরসির হিসাব বলছে, আক্রান্তের দিক দিয়ে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৩ হাজারের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মারা যান ছয় হাজারের বেশি। গড়ে প্রতিদিন ৩৬ জন নতুন করে আক্রান্ত হন।

পরিসংখ্যানে বলা হয়, স্তন ক্যানসার বিশ্বের সব দেশে নারীদের ক্যানসারজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ। প্রতি ১০ নারীর মধ্যে একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এতে আক্রান্ত হন। ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে কেবল স্তন ক্যানসারে মারা গেছেন ছয় লাখ ৭০ হাজার নারী। আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ। ৪০-৫৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি (৩২ দশমিক ৮ শতাংশ)। তবে তরুণীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন, এমনকি পুরুষের মধ্যেও আক্রান্তের হার প্রায় ১ শতাংশ।

চিকিৎসকরা মনে করেন, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা এবং নিয়মিত পরীক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই জীবন রক্ষা করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে চিকিৎসার সাফল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। তাই গণমাধ্যম, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো এখন আগের তুলনায় আরও জরুরি।


বিজ্ঞাপন


স্তন ক্যানসার কী?

চিকিৎসকেরা বলছেন, স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়।

breast-cancer2

সেটি রক্তনালীর লসিকা (কোষ-রস) ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যানসার।

স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিতে যারা

পরিবারে মায়ের দিকের নিকটাত্মীয় যদি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, একজন নারীর স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এছাড়া ১২ বছর বয়সের পরে মাসিক শুরু হওয়া বা ৫৫ বছরের পরেও মেনোপজ না হওয়া—অর্থাৎ দেরিতে মেনোপজও ঝুঁকি বাড়ায়। পোস্ট-মেনোপজাল সিন্ড্রোমের চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ সময় হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি নিলে, ৩০ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ বা শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, জিনগত মিউটেশন, স্থূলতা, কম শরীরচর্চা, ধূমপান ও মদ্যপান—সবই স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ঝুঁকিও বাড়তে থাকে।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. শাহিদুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নারীদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকলেও, পুরুষেরাও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে এই রোগ পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব। তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।’

তিনি বলেন, দেশে জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র, কর্মপরিকল্পনা ও কার্যকর কর্মসূচি নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অধিদফতর ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন চালু নিয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ভূমিকা হতাশাজনক। ক্যানসার স্ক্রিনিং চলছে অসংগঠিত, অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে।’

আরেক ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের ঝুঁকির কারণ শুধু জিনগত নয়, এর সঙ্গে জীবনযাত্রার অভ্যাস ও পরিবেশগত কারণগুলোও জড়িত। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে জিনগত, অর্থাৎ পরিবার কিংবা নিকটাত্মীয়ের স্তন ক্যানসার বা বিআরসিএ১/বিআরসিএ২ মিউটেশনের কারণে হয়ে থাকে। ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অভ্যাসগত কিংবা পরিবেশগত কারণে স্তন ক্যানসার হয়ে থাকে। যেমন দেরিতে বিয়ে করা, দেরিতে সন্তান নেওয়া, কম সন্তান নেওয়া বা নিঃসন্তান হওয়া, শিশুকে বুকের দুধ পান না করানো, কায়িক পরিশ্রম কম করা, ধূমপান করা ইত্যাদি।

প্রতিরোধে করণীয়

বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত ক্যানসার পরীক্ষা এবং সময়মতো চিকিৎসার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা নিলে শতভাগ রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব। তারা বলছেন, শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানো, মানসিক শান্তি বজায় রাখা, নিয়ন্ত্রিত ওজন রাখা এবং ২০-৩০ বছর বয়স থেকে নিয়মিত স্তন পরীক্ষা শুরু করা জরুরি। ৩০-৪৫ বছর বয়সী নারীদের প্রতি বছর পরীক্ষা ও ম্যামোগ্রাফি করানো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

breast-cancer_4

ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সোসাইটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. সৈয়দ হুমায়ুন কবির বলেন, আগে স্তন ক্যানসার মরণব্যাধি হলেও এখন আর নেই। এখন এর পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমরা এই রোগ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নই।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ও স্কয়ার হাসপাতালের অনকোলজি সেন্টারের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘স্ক্রিনিং না করার কারণে দেশে ক্যানসার শুরুতেই শনাক্ত হওয়ার হার কম। সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার রোগীর জন্য জরুরি রেডিওথেরাপি যন্ত্র কার্যকরভাবে কাজ করছে না। যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে রোগীদের অনেক বেশি অর্থ ব্যয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। চিকিৎসা বাবদ দেশ থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশেই ক্যানসারের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে এই অর্থ যাওয়া বন্ধ হতো এবং মানুষের দুর্ভোগও কমত।

এসএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর