শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

টাইফয়েড টিকা নিয়ে বিভ্রান্তির নেপথ্যে কী?

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

টাইফয়েড টিকা নিয়ে বিভ্রান্তির নেপথ্যে কী?
ছবি: ঢাকা মেইল।

দেশে প্রথমবারের মতো শিশুদের বিনামূল্যে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া হচ্ছে। মাসজুড়ে চলবে এই টিকাদান কর্মসূচি। তবে এই কর্মসূচি চলার শুরুতেই টিকার কার্যকারিতা ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ছড়ানো হচ্ছে নানা গুজব। কেউ কেউ পরিকল্পিতভাবে জনমনে ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনোভাবেই এই টিকা শিশুদের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং এটি নিলে শিশুরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিনামূল্যে চার কোটি ৮৯ লাখ শিশুকে টাইফয়েডের টিকাদানের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় দুই কোটি শিশু টিকার জন্য ভ্যাক্সইপিআই ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেছে। টাইফয়েড থেকে শিশুদের রক্ষায় ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় পাঁচ কোটি শিশু ও কিশোরকে বিনামূল্যে এক ডোজের টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) নিশ্চিত করতে চায় সরকার।


বিজ্ঞাপন


তথ্য অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত স্কুল ও মাদরাসায় এই টিকা পাবে। এরপর ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী অন্যান্য শিশুরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা পাবে। শহরের পথশিশুদের টিকাদানের দায়িত্বে থাকবে বিভিন্ন এনজিও। প্রতি বছর পাঁচ লাখের বেশি মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগই শিশু।

এদিকে, টাইফয়েডের চিকিৎসায় যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে, এর একটা অংশ হয়ে পড়েছে অকার্যকর। ফলে ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েডের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। রোগটিতে আক্রান্ত হলে আর্থিক ক্ষতি, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা এবং মৃত্যুও ঘটে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, টাইফয়েড জ্বর স্যালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি সংক্রমণ, যা দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। উপসর্গের মধ্যে থাকে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, ক্ষুধামন্দা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া। প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ অস্পষ্ট থাকায় অনেক সময় টাইফয়েড শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।


বিজ্ঞাপন


দ্য গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ ৭৮ হাজার রোগী আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মৃত্যু হয় আট হাজার। যার ৬৮ শতাংশই শিশু। শিশুদের মধ্যে টাইফয়েড আক্রান্তের হার বেশি।

এদিকে টাইফয়েডের টিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে গুজব। অনেকেই বলছেন, টিকাটি ভারতের সিরাম ইনটিস্টিউটের তৈরি। পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশের শিশুদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। টিকাটি নিলে ক্ষতি হবে এবং শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হবেন।

vacination_20251014_123658565
সালমোনেলা টাইফি দ্বারা সৃষ্ট একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ টাইফয়েড জ্বর

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টিকা টাইফয়েড প্রতিরোধে ৯৫ শতাংশের বেশি সুরক্ষা দিতে সক্ষম। টিকাটি সবার জন্য নিরাপদ। টিকা দেওয়ার পর সামান্য জ্বর বা ইনজেকশনের স্থানে হালকা ব্যথা ছাড়া অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এই ক্যাম্পেইন সফল হলে টাইফয়েড প্রতিরোধে বাংলাদেশ একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করবে। দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত এ ব্যাধি থেকে শিশুদের সুরক্ষায় এটি হবে সরকারের একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

তারা আরও বলছেন, এটা কোনো ট্রায়ালের টিকা নয়। আর ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়। তারা শুধু মার্কেটিং ও বাজারজাত করে। বিশ্বের ২১ দেশে ইউনিসেফের দেওয়া টিকা আর বাংলাদেশে দেওয়া টিকা একই। এই টাইফয়েড টিকা শতভাগ নিরাপদ।

টাইফয়েডের টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত জানিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, দেশে টাইফয়েডের প্রকোপ বেশি এবং এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল। দেশে প্রতি বছর অনেক শিশু মারা যায়। ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক অ্যান্টিবায়োটিকও কার্যকর হয় না। করোনার সময় অনেকের মনে ভয় ছিল, টিকা নিলে না জানি কী হয়। সুযোগ থাকলে নিঃসন্দেহে আমিই প্রথম টাইফয়েডের টিকা নিতাম।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘টাইফয়েডের টিকা অন্যান্য টিকার মতো। শিশুদের ইপিআইসহ কয়েকটি টিকা দেওয়া হয়; ওই টিকাগুলোর মতোই টাইফয়েডের টিকা। এই টিকাতে সামান্য কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। কারো জ্বর হতে পারে, কারো ব্যথা হতে পারে এবং কারো চুলকানি বাড়তে পারে। এছাড়া অন্য কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের দেশে যেসব অভিভাবক সচেতন তারা বাচ্চাদের প্রাইভেটভাবে টিকা দিয়ে থাকেন। এটি এখন জাতীয়ভাবে দেওয়া হচ্ছে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যারা দূষিত পানি পান করে এবং দূষণের শিকার হয়; তারা টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। সুতরাং টাইফয়েডের টিকা শিশুদের জন্য বড় একটি সুরক্ষা। টাইফয়েড হলে জীবনেরও ঝুঁকি থাকে। টাইফয়েডের টিকা দেশের জন্য মঙ্গলজনক এবং সবার নেওয়া উচিত।’

বেনজির আহমেদ বলেন, ‘সিরাম একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং এর সুনাম সারা বিশ্বে রয়েছে। জাতীয় কোনো ক্যাম্পেইনে টিকার মান যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ নেওয়া হয়। টিকার মান ভালো না হলে বাংলাদেশে এই টিকা প্রয়োগ করা হতো না এবং চিন্তার কিছু নেই। এই টিকা নিলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

এ বিষয়ে জনস্বার্থ বিশেষজ্ঞ ডা. আয়েশা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যেকোনো ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। প্যারাসিটামলেরও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। কিন্তু সবার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না, অল্প মানুষের হয় এবং এটা হতেই পারে। আমরা একটা ওষুধ প্রয়োগ করি, সেটা সবার জন্য দেওয়া হয়। কারোই সমস্যা হয় না, এক বা দুজন ছাড়া। যাদেরই সমস্যা হয় সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যায়। টিকা নেওয়ার পর কারও কারও জ্বর আসে এবং ব্যথা হয়, এটা ভালো। জ্বর বা ব্যথা এটা সাময়িক, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে। আগে থেকেই দেশে টাইফয়েড ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। আর এটা দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে।’

ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘টাইফয়েড আসলে মারাত্মক রোগ। চিকিৎসা না নিলে রোগী মারা যায়। আর এই রোগ প্রতিরোধ করা উচিত। সবসময় স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে হবে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে চলতে হবে। যেকোনো ভ্যাকসিনই শুরুতে মানুষ নিতে চায়। করোনার ভ্যাকসিনের সময়ও আমরা দেখেছি, অনেকেই সন্দেহ করত। টাইফয়েডের টিকা নিলে অনেকটাই মৃত্যুর ঝুঁকি কমে আসে। কিছু মানুষের অভিযোগ-অনুযোগ থাকতে পারে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই টিকাটি শতভাগ পরীক্ষিত। দেশে আগে বেসরকারিভাবে শিশুদের টিকা দেওয়া হতো। এখন আশার বাণী হলো, সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশে টিকা প্রদান করে বেসরকারিভাবে। এই টিকাটি ব্যয়বহুল। অনেকেই চাইলেও এই টিকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য রাখেন না। সরকার ব্যয়বহুল টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যার ফলে অনেকের ব্যবসায় ভাটা পড়ে, এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নামে-বেনামে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সরকারিভাবে এই টিকা দেওয়া হলে কেউ আর বেসরকারি টিকা নিতে চাইবে না এবং বেসরকারি কোম্পানির ব্যবসায় ভাটা পড়বে।’

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর