শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

হাসপাতালটি কমাচ্ছে বিদেশমুখিতা, বছরে সাশ্রয় ৫০০ কোটি টাকা

মাহাবুল ইসলাম
প্রকাশিত: ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪৯ এএম

শেয়ার করুন:

হাসপাতালটি কমাচ্ছে বিদেশমুখিতা, বছরে সাশ্রয় ৫০০ কোটি টাকা
এআই দিয়ে তৈরি ছবি।
  • বিএনপির নেওয়া প্রকল্পে আ.লীগ সরকারের গড়িমসি
  • ১৮ বছরে সাশ্রয় হতে পারত ৯ হাজার কোটি টাকা 
  • মিলছে ৭ লাখ রোগীর চিকিৎসা, নিম্নমুখী অন্ধত্বের হার
  • কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ করতে একগুচ্ছ সুপারিশ

 


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার পেছনে গড়ে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে খরচ করে থাকে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার হতাশা, চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা ও আস্থার সংকট এর পেছনে মূল কারণ। তবে এই অন্ধকার বাস্তবতায় যেন আশার আলো জ্বালিয়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

এটি এখন আর কেবল চক্ষু চিকিৎসার একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং বিদেশনির্ভরতাকে প্রতিহত করে দেশীয় চিকিৎসায় আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, এই প্রতিষ্ঠানের উন্নত চিকিৎসার ফলে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার রোগী চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যেতেন। যেখানে একেকজনের ব্যয় হতো গড়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। শুধু এই এক খাতেই বছরে এখন সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। এখন রোগীরা দেশের মাটিতে চিকিৎসা পাচ্ছেন, বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ চক্ষু রোগীর। 

১৯৭৯ সালে মাত্র ১০০ শয্যার হাসপাতাল থেকে যাত্রা শুরু প্রতিষ্ঠানটির। সময়ের সাথে বাড়ে মানুষের রোগ, বাড়ে চিকিৎসার চাহিদা। অন্যদিকে, কমে হাসপাতালের প্রযুক্তির পরিসর, ছোট হয়ে আসতে থাকে এই হাসপাতালের দেয়াল। অবশেষে ২০০৩ সালে শুরু হয় এক নতুন স্বপ্নের বুনন। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রাথমিকভাবে ৮৭ কোটি ৭৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকায় শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত  প্রকল্পটি গিয়ে দাঁড়ায় ১৩৩ কোটি ৪৭ লাখ.৭৭ লাখ টাকায়। যার মধ্যে সৌদি উন্নয়ন তহবিলের সহযোগিতা ছিল অন্যতম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পটি বিএনপি-জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালে নেওয়া। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রকল্পটিতে নেমে আসে স্থবিরতা। প্রায় ১৮ বছর ধরে টানা সাত দফা মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি মূল ডিপিপি অনুসারে ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল। ২০০৬ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে ১৮ বছরে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যেত। প্রকল্পটি ২০১৯ সালে শেষ হয়েছে। আইএমইডির তথ্যমতে, গত তিন বছরে অন্তত এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উন্নত চিকিৎসার ফলে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা এটি আমাদের দেশের স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে। এটা কখনোই কাম্য নয়। এই প্রকল্পেও যে দীর্ঘসূত্রিতা হয়েছে, সেটি কেন হয়েছে, এটা খুঁজে বের করা উচিত। একই সঙ্গে এটার সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইন্ধন বা স্বার্থসিদ্ধির বিষয় থাকলে অথবা উদাসীনতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’ 

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বছরে ৫০০ কোটি টাকার যে সাশ্রয় সেটি আমাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে হবে। শুধু একটি বিষয়ে নয়, পুরো চিকিৎসা খাতকে ঢেলে সাজালে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমবে। একই সঙ্গে চিকিৎসার নামে যে অর্থ পাচার হয়, সেটিও রোধ করা যাবে।’ 

আরও পড়ুন
লুটপাটে প্রাণ বাঁচানোর প্রকল্পেই নেই প্রাণ! 

এই ইনস্টিটিউট শুধু চোখের ছানি বা কর্নিয়ার চিকিৎসা দেয় না। এটি এখন একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স। গ্লুকোমা, রেটিনা, ইউভিয়া, নিউরো-অফথালমোলজি, শিশু চক্ষু, অরবিট ও ওকুলোপ্লাস্টিক সার্জারির ৯টি বিশেষায়িত বিভাগ চলছে পূর্ণমাত্রায়। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির সহায়তায় এখানে হচ্ছে জটিল অপারেশন, দেওয়া হচ্ছে লেজার থেরাপি। হচ্ছে গবেষণাও।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে চোখে গুরুতর আঘাত পান এক হাজার ৭৪ জন। এর মধ্যে ৭৯৬ জনকে এই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং বেশির ভাগই দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। ৩৯ জনের চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়, তবে বাকিরা আংশিক বা পুরোপুরি সুস্থ হন। সরকার ৯ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায়। এ সময় সিঙ্গাপুর, চীন, নেপাল ও যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা এসে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রশংসা করেন।

নীরব হাসান নামের এক রোগী বলেন, ‘একটা দুর্ঘটনায় আমার দুই চোখই মারাত্মক আঘাত পায়। আহত হওয়ার পর আমার এক চোখে আলো হারানোর উপক্রম হয়েছিল। ধারদেনা করে ভারত যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। পরে ডাক্তারা জানান, এখানেই উন্নত চিকিৎসা সম্ভব। এই হাসপাতালের উন্নত চিকিৎসা না পেলে হয়তো চোখটি হারাতে হতো।’ শুধু নীরব নন, তার মতো হাজারো জীবনের আলো দেখানোর সঙ্গী হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটির সফলতার পেছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, নিরলস প্রস্তুতি। এখন পর্যন্ত ১৩৯ জন চিকিৎসক এফসিপিএস, ২৫ জন এমএস, ১১৬ জন ডিও, ১৩৩ জন ফেলোশিপ ও ৬৪৯ জন এইচএমও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। চালু হয়েছে দুটি গবেষণা জার্নাল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত হয়েছে ২০০টি কমিউনিটি ভিশন সেন্টার। যেখানে গ্রামের মানুষও পাচ্ছেন প্রাথমিক চক্ষু চিকিৎসা।

অন্ধত্ব প্রতিরোধেও এই ইনস্টিটিউট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ২০২০ সালের Blindness Survey অনুযায়ী, ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে জনগণের মধ্যে অন্ধত্বের হার ১.৫৩% থেকে নেমে এসেছে ১.০% এ। অপারেশনযোগ্য ছানি (Cataract) হচ্ছে অন্ধত্বের প্রধান কারণ, যা এই ইনস্টিটিউট দক্ষতার সাথে প্রতিরোধ করছে। Orbis International-এর সহায়তায় ২৩ হাজার জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালে হাসপাতাল থেকে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৯০ হাজার ৬৮৭ জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৭২ জনে এবং ২০২৪ সালে রোগী ছিল ৭ লাখ ১ হাজার ২৫০ জন। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে চিকিৎসা সেবা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৩ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ে।

এদিকে, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম আরও প্রসারিত করতে একগুচ্ছ সুপারিশ দিয়েছে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডি। সুপারিশে বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রকল্পে বিদেশি ঋণের নিশ্চয়তা আগেই নিশ্চিত করতে হবে। যেন প্রকল্পের কাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। ডিপিপিতে অটোমেশন কম্পোনেন্ট যুক্ত করতে হবে। ৬ তলা ভবনকে ১০ তলায় রূপান্তর করে জরুরি বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটারের অবস্থান পুনর্গঠন করতে হবে। চিকিৎসকদের জন্য গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে, নার্সদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে এবং জাতীয়ভাবে একটি রেফারেল পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।

হাসপাতালের সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জানে আলম মৃধা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের এখানে তো এখন ৮০০ বেড। যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন রোগী সংখ্যা ছিল ৫০০ জন। এখন রোগী সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। ফ্যাসিলিটি বাড়লে বিদেশি রোগী গমনের হার আরও কমে আসবে। রোগীর সেবা প্রদান করতে এ প্রতিষ্ঠান অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। তবে বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অত্যন্ত দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চব্বিশের মতো বড় চ্যালেঞ্জ সফলতার সাথে মোকাবেলা করা হয়েছে এবং এখনো যা চলমান।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রকল্প নেওয়া ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ভুল ও অনিয়মের চিত্র থাকে। এগুলো দূরীকরণে শক্তিশালী পদক্ষেপ প্রয়োজন। একইসঙ্গে এসব জাতীয় প্রতিষ্ঠান কিছু বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে, কিন্তু তারপরেও তো বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। গুণগত মানের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা গেলে চিকিৎসা খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব।’

এমআই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর