রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জুলাই আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মীদের সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে টানা ১৫ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে চিকিৎসা কার্যক্রম। বর্তমানে কেবল জরুরি বিভাগে সীমিত পরিসরে সেবা চলছে। বন্ধ রয়েছে অপারেশন থিয়েটার (ওটি), ইনডোর, আউটডোরসহ অন্যান্য বিভাগ।
এই বিশেষায়িত চক্ষু চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে সেবা নেওয়া তিন হাজার রোগী এখন চিকিৎসাবঞ্চিত। তীব্র চোখের যন্ত্রণায় ভোগা রোগীরা নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন, অনেকেই ছুটে এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে।
বিজ্ঞাপন
হাসপাতাল কার্যত জিম্মি, আতঙ্কে কর্মীরা
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের একটি ফটক বন্ধ, বাইরে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ ও আনসার সদস্য। অভ্যন্তরে কাজ করছেন হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স। অধিকাংশ চিকিৎসক-নার্স হাসপাতালে আসতে ভয় পাচ্ছেন। ২৮ মে যে হামলা চালানো হয়েছিল, তার পর থেকে সবার মধ্যে গভীর আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কিছুক্ষণ পর পর সারাদেশ থেকে আসছেন চক্ষু রোগীরা। কেউ আসছেন চোখের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে জরুরি সেবা নিতে, কেউ আবার আসছেন সাধারণ সেবা নিতে কিংবা শিডিউলের তারিখ অনুযায়ী অপারেশন করতে। তবে অল্প সংখ্যক চিকিৎসক আর নার্স দিয়ে সীমিত পরিসরে জরুরি বিভাগে চালু রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের সেবা বন্ধ থাকায় দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবাসিক সার্জনদের রুমে বসে সাংবাদিক সঙ্গে কথা বলছেন হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জানে আলমসহ অল্প কয়েকজন চিকিৎসক। তারাও রয়েছেন আতঙ্কে।

বিজ্ঞাপন
হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিভাগ তালাবন্ধ, পড়ে আছে অত্যাধিুক যন্ত্রপাতি। আশঙ্কা রয়েছে দামি দামি মেশিন নষ্ট হওয়ার। চতুর্থ তলার স্পেশালইজড ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিটে তিনজন জুলাই আন্দোলনে আহত রয়েছেন। প্রথম সাংবাদিকদেরকে দেখে ইউনিটের কেচি গেইটে তালা লাগিয়ে দেন জুলাই আহতরা। পরে ডাকাডাকি করা হলে তারা তালা খুলে দেন এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
জুলাই আন্দোলনে আহত গুটি কয়েকজন হাসপাতাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, যেন ৬০০ কোটি টাকার অত্যাধুনিক হাসপাতালটি আবাসিক হোটেলে রুপান্তর হচ্ছে।
চতুর্থ তলার স্পেশালাইজড ইউনিটে বর্তমানে পাঁচজন আহত অবস্থায় রয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জুলাই আন্দোলনে আহত মোট ৫৬ জনের মধ্যে ৫১ জন বর্তমানে হাসপাতালের বাইরে, ঈদ উপলক্ষে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করছেন।
আধিপত্য বিস্তার ও চিকিৎসাসেবা বন্ধের পেছনে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ
হাসপাতাল সূত্র বলছে, কিছু আহত ব্যক্তি প্রায় ‘আবাসিক’ রূপে হাসপাতাল জুড়ে অধিপত্য বিস্তার করছেন। চিকিৎসক-নার্সদের দেখলেই গালাগাল করছেন, হুমকি দিচ্ছেন, ফলে কর্মীরা কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
তবে আহতদের বক্তব্য ভিন্ন। তাদের দাবি, দেশে তারা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। উন্নত চিকিৎসার দাবিতে তারা ইউরোপ বা আমেরিকায় যাওয়ার অনুমতি চান। তারা বলছেন, চিকিৎসকরা তাদের "অপমান ও অবহেলা" করছেন, এবং বিদেশে রেফার করার অনুরোধ বারবার উপেক্ষা করা হচ্ছে।
আহতদের বক্তব্য: ‘বিদেশে নিতে হবে’
নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় গত ১৮ জুলাই আন্দোলনে আহত হন নুর আলম। বর্তমানে চোখের সমস্যা নিয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল এবং সিএমএইচে চিকিৎসা নিয়েছি। আমার দুই চোখে এখনো পাঁচটি পিলেট (বল আকৃতির ছোট ছোট গুলি) রয়েছে। মাথায় স্প্লিন্টার। আমরা কোনো বাধা দিচ্ছি না, চিকিৎসা চাই। কিন্তু চিকিৎসকরা আমাদেরকে রেফার করছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের (জুলাই আন্দোলনে আহতরা) কষ্টের কোনো শেষ নাই, আমরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছি না। আমরা যথাযথ চিকিৎসা চাই।’
নুর আলম বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের বারবার বলেছি, আমাদেরকে বিদেশে রেফার করেন, সেখানে আমরা সুচিকিৎসা পাবো। কিন্তু আমাদেরকে রেফার করা হচ্ছে না। আর পরিচালক বলেন, আমাদেরকে যাদের রেফার করার কথা বলা হয়, তাদেরকে রেফার করি।’
তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালে দুর্নীতিবাজ কিছু চিকিৎসক রয়েছেন। চিকিৎসক এবং ওয়ার্ড বয়রা মিলে পুরো হাসপাতাল জিম্মি করে রেখেছেন। সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চিকিৎসা দেন এবং আমাদেরকে ব্লাকমেইল করছেন। এখন কাউকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসকরা নিজেরা সিন্ডিকেট করে হাসপাতাল বন্ধ রেখেছেন। আমরা থাকলে তারা (চিকিৎসকরা) দুর্নীতি করতে পারবে না, আমাদের পক্ষ থেকে সেবা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’
‘আমরা সুচিকিৎসা চাই। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যেতে চাই। এখন আমাদেরকে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। এসব অপবাদ নেওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
জুলাই আন্দোলনে আহত রাজু ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদেরকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসার নামে এরা (চিকিৎসক) তামাশা করছে, আমরা হাসপাতালে থাকতে চাই না। চোখের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। আমার ডান চোখে ৮ বার অপারেশন করা হয়েছে। এখন চিকিৎসকরা বলছে, চোখ তুলে ফেলতে হবে, তাহলে চিকিৎসকরা এতোদিন কী করেছে। আমাদেরকে নিয়ে ডিপ্লোমা কোর্স করা হচ্ছে এবং চিকিৎসকরা শিখছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের চোখের চিকিৎসা ভালো নয়। বিদেশে আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা কর হোক; সেখানে আমরা চিকিৎসা নেব। এখন চিকিৎসা নিতে না পারলে চোখ হারাতে হবে।
তিনি বলেন, আন্দোলনে আহত একজনকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে দুমাস রাখা হয়েছে। দুমাসে তাকে মাত্র তিনবার চিকিৎসক দেখানো হয়েছে। পরে তিনি সুস্থ হননি। আমরা আরও ভালো বা উন্নত চিকিৎসা চাই। চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। আমাদের কথা কেউ শুনছে না।
জুলাই আন্দোলনে আহত আবু হানিফ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা পরিচালকের পদত্যাগ চাই। আমাদের ওপর হামলার মূল কারিগর তিনি। কিছু পক্ষ আমাদেরকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকরা বলছেন, আমাদের চোখ ওঠানোর জন্য, অনেকেই নিজ উদ্যোগে বাহিরে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। পরে তাদের চোখ ভালো হয়েছে, চোখ ওঠানো লাগেনি। তাদের যে সমস্যা, আমাদেরও একই। আমরা চাই বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে। ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়; যেখানে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।’
আবু হানিফ বলেন, ‘কিছুদিন আগে চারজন চিকিৎসা না পেয়ে বিষপান করেছিল। তাদের মধ্যে একজন সিঙ্গাপুর চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। পরে এখানের চিকিৎসকরা সিঙ্গাপুরের ডাক্তারদেরকে বলে দিয়েছে, যাতে তাকে ভালো চিকিৎসা না দেয়া হয়। দুই মাসের মধ্যে একদিন তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল, তাতে তার কোনো কাজ হয়নি।’
চিকিৎসকদের অবস্থান: ‘নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করা সম্ভব নয়’
একজন চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা রোগীদের চিকিৎসা দিতে চাই, কিন্তু ভয় এবং হুমকির মধ্যে কাজ করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে একবার হামলা হয়েছে, আবার যে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই।’
একজন নার্স বলেন, ‘আমরা ভালো ব্যবহার করলেও তারা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এ অবস্থায় সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।’
ইমার্জেন্সি বিভাগে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক ঢাকা মেইলকে বলেন, জরুরি বিভাগে সেবা দিতেও ভয় লাগে। আগে একবার আমাদের উপর হামলা করা হয়েছে এবং শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়েছে। আবার কখন হামলা করে বসে, সেটি আমরা পারি না। তারা খুবই উগ্র, কোনো কথাই শুনে না।

তিনি আরও বলেন, আমরা রোগীদেরকে সেবা দিতে চাই। রোগীদেরকে সেবা দেয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকি, অনিরাপদ কর্মস্থলে সেবা দেয়া সম্ভব নয়। সবারই চাওয়া থাকে নিরাপদ কর্মস্থল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালে কর্মরত একজন নার্স ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে যারা হাসপাতালে রয়েছেন তারা খুবই উচ্ছৃঙ্খল। তাদের কাছে গেলেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এবং যা তা বলে। সেবা দেওয়ার মতো পরিবেশ নাই, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেও তারা উল্টোটা আমাদের সঙ্গে করে।’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সেই চিকিৎসা অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্রও অনুসরণ করা হচ্ছে। তবুও আহতরা চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে যাচ্ছেন।
প্রশাসনিক অচলাবস্থা, সমাধানে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম জানান, বর্তমানে কেউ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। আহতদের মধ্যে কেউ হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই অবস্থান করছেন।
তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। জুলাই আন্দোলনে আহত বর্তমানে যারা হাসপাতালে রয়েছে তারা কোনো নিয়ম নীতি মানে না। তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে, তারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের একজনেরও বর্তমানে হাসপাতালে থাকার কোনো প্রয়োজন নাই, তারা জোর করে হাসপাতালে আছে।’
সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক-নার্সরা আতঙ্কিত, সেবা কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’
২৮ মে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
এসএইচ/ইএ

