শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

প্রাণঘাতী সংক্রামকের ভূমিকায় আত্মহত্যা

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১১ জুন ২০২২, ০৪:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

প্রাণঘাতী সংক্রামকের ভূমিকায় আত্মহত্যা

ঢাকার ধামরাইয়ের বাসিন্দা আকরাম হোসেন (১৮)। একাদশ শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে প্রতিবেশী নবম শ্রেণির ছাত্রী রুমা আক্তারের। দুই পরিবারে বিষয়টি জানাজানি হলে রুমার পরিবার থেকে তা বিচ্ছিন্ন করার জন্য চাপ বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় সে আকরামকে ডেকে সম্পর্কচ্ছেদের কথা জানায় রুমা। এ সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে ৮ জুন বিষপান করে আত্মহত্যা করে আকরাম।

জাইনা হাবীব প্রাপ্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাজধানীর আদাবরের জাপান গার্ডেন সিটির ১৬ তলা ভবনের দু’তলায় বসবাস করতেন। গত ১ জুন বিকেলে হঠাৎ ভবনে উপর থেকে বিকট আওয়াজে কিছু পড়ার শব্দে আশপাশের লোকজন ছুটে আসনে। এ সময় তারা ভবনের নিচে থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত মরদেহ আবিষ্কার করেন। পরে প্রতিবেশি ও বাড়ির দারোয়ান মৃতদেহটি প্রাপ্তির বলে শনাক্ত করেন। পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা ছাদে পাওয়া সুইসাইড নোট দেখে নিশ্চত হয় সে আত্মহত্যা করেছে। কারণ বিষন্নতা।


বিজ্ঞাপন


ঘটনার ধরন ভিন্ন হলেও পরিণতি একই অপর শিক্ষার্থী আহমেদ বিন রাফির। তিনি রংপুরের বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মেডিকেল পড়তে আসা ছেলেটি মেডিকেল জীবনের প্রথম বর্ষ পার হওয়ার আগেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যায় সঙ্গে একটি পরিবারের দীর্ঘদিনের লালন করা স্বপ্নের চিরবিদায় হলো। রাফির এই অকাল প্রয়াণের কারণ টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় এনাটমি বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়া। পর পর দুইবার পাস করতে ব্যর্থ হওয়ার পর আহমেদ বিন রাফি ২০২১ এর ৫ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করেন।

রাফি, প্রাপ্তি, আকরামের মতো অনেক শিক্ষার্থী প্রতিবছর অকৃতকার্য, পারিবারিক কিংবা প্রেম ঘটিত নানা কারণে আত্মহত্যা করেন। তবে করোনাকালে এ ধরনের ঘটনা যেনো মহামারীর মধ্যে আরেকটি মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনাকালে এক বছরে সারাদেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধুমাত্র দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৯ জন। আঁচল ফাউন্ডেশন নামে এক সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়৷

দেশের প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, এ বছরে ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অনার্স কলেজের অন্তত একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বছেরের শুরুতে করা জরিপের তথ্যমতে, আত্মহত্যা করা ১০১ জনের মধ্যে ৬২ জন বা ৬১ দশমিক ৩৯ ভাগই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সময়ে মেডিকেল কলেজ ও অনার্স কলেজের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ১১ দশমিক ৮৮ ভাগ। গত বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ ভাগ, যা সংখ্যায় ২৩।

বয়স ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা যায় ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়সসীমার ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৭ জন রয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


suicide

উচ্চ শিক্ষা স্তরের এসব শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মহামারীর মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় হতাশাকে কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। এমন কি সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও এবার পুরুষ আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা নারীদের প্রায় দ্বিগুণ। করোনার মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলেই পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান আঁচল।

সড়ক দুর্ঘটনা থেকেও আত্মহত্যায় অধিক মৃত্যু

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আঘাত প্রতিরোধ ও গবেষণা সেন্টারের এক  অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিবছর আঘাত জনিত কারণে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় আত্মহত্যায়। প্রতি লাখে প্রায় ১৪ দশমিক ৭০ জন মানুষ প্রতিবছর আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেন। এটি সর্বগ্রাসী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর থেকেও বেশি। প্রতিবছর লাখে ১৪ দশমিক ৪০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারা ২০১৬ সাল থেকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। 

প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, প্রতিবছর ২৩ হাজার ৮৬৮ জন আত্মহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। এ হিসেবে প্রতিদিন ৬৬ জন মৃত্যুবরণ করেন। অপরদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ২৩ হাজার ১৬৬ জনের মৃত্যু হয়। যা প্রতি দিন গড়ে ৬৪ জন। এদিকে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে প্রতি লাখে ২৮ দশমিক ৮০ ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর, সর্বোচ্চ ৪৪ দশমিক ৯০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ১৭, ২৪ দশমিক ৩০ ভাগের বয়স ১৮ থেকে ২৪, ১৩ দশমিক ৭০ ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৩৯, ৩ দশমিক ৭০ ভাগের বয়স ৪০ থেকে ৫৯ এবং ২১ দশমিক ৯০ ভাগের বয়স ষাটের বেশি। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। 

আত্মহত্যার কারণ কী?

জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আত্মহত্যা দুইটি নির্দিষ্ট বয়সের গ্রুপের মধ্যে বেশি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর ও তরুণদের গ্রুপে ঘটে থাকে। ১২ থেকে ২৫ বা ২৭ সর্বোচ্চ ৩০ এই গ্রুপের আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। এর কারণ এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্রাইসিস এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। এত রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ব্যক্তিত্বের যে বলিষ্টতা, মানসিক কাঠামোর যে স্থিতিশীলতা এবং পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়া বা আবেগ নিয়ন্ত্রণের যে সক্ষমতা তা তাদের থাকে না। বিশেষত সম্পর্কের বিষয়গুলোকে ম্যানেজ করার যে বিষয় তা তারা করতে পারেন না। পরীক্ষায় খারাপ ফল, চাকরি না পাওয়া, প্রেমে ব্যর্থতার মতো না পাওয়ার যে বিষয়গুলো রয়েছে তা তারা মেনে নিতে পারে না। পরাজয়কে তারা জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন না। এই বিষয়গুলোর জন্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। এখন সময়টা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং ফলে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে। 

‘করোনা পরবর্তী বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে তাদের উপর চাপ, চ্যালেঞ্জ বাড়ছে, বাধা বিপত্তি বাড়ছে কিন্তু মোকাবিলার জন্য যে মানসিক সক্ষমতা, ম্যাচিউরিটি তা তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে না। তাদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তাই তারা সহজেই হতাশ হয়, মানসিকভাবে ভেঙে পরে এবং একসময় আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে’, যোগ করেন অধ্যাপক তাজুল। 

বয়স্কদের আত্মহত্যার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অধিক আত্মহত্যা প্রবণ অপর গ্রুপটি হলো বয়স্ক গ্রুপ। তাদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ মানসিক রোগ। বেশি বয়সে মানুষের মধ্যে বিষন্নতাভাব প্রবলভাবে কাজ করে। বিষন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক রোগ। এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। ষাটোর্ধ্ব বয়সে অক্ষমতা, অসহায়ত্ব প্রবলভাবে দেখা দেয় এবং ব্যক্তি নিজেকে নেতিবাচক একটি অবস্থায় আবিষ্কার করে। মনেহয় এখান থেকে উঠে আসা যাবে না। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সে মৃত্যুকেই সবথেকে সহজ উপায় মনে করে।’ 

মানসিক পরিস্থিতি তুলে ধরে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘জীবনের দীর্ঘ সময় পরিপূর্ণ একটি জীবন যাপন শেষে অবসর গ্রহণের পর ব্যক্তির উপার্জন কমে যায়, তার শারীরিক সক্ষমতা আগের মতো নেই। সম্পর্কগুলোর গভীরতা কমে গেছে, পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব যারা সাথে ছিলো তারা তখন অনেকটাই দূরে চলে যায়। তাই এই বয়সে ডিপ্রেশন তৈরি হয়। সক্ষম অবস্থা থেকে হঠাৎ সে নিজেকে পরনির্ভরশীল হিসেবে আবিষ্কার করে। যা মেনে নেওয়া অনেকের জন্য অত্যন্ত কঠিন।’

suicide

সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে

আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় উল্লেখ করে বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে রাষ্ট্র, সমাজ,পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানদের শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে কিছু শিক্ষার্থী হয়তো মানসিক সাহায্য চাচ্ছে। তারা হয়তো মানসিকভাবে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। তাদেরকে সহয়তা দেওয়া, পাশে দাড়ানো এবং তারা যেনো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে পারে সেজন্য মানসিক সমর্থন প্রদান করতে হবে। চাকরি বা আয় উপার্জনের সক্ষমতার জন্য রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে হবে। রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক বৈষম্যে বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে। এছাড়া মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের তাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। চাকরি প্রত্যাশী তরুণদের মানসিক সমর্থন প্রদান করতে হবে। ’ 

বয়স্কদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে রাষ্ট্রকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বৃদ্ধদের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। যেনো তারা আর্থিকভাবে দৈণ্যতার স্বীকার না হন। তাদের জন্য সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার প্রতিবারই এধরনের উদ্যোগের কথা বলে কিন্তু কতটা বাস্তবায়ন হয় সে বিষয়েও নজর রাখতে হবে। বাইরের দেশে প্রবীণদের পরিবারের উপর নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে তারা সম্পূর্ণভাবেই পরিবারের উপর নির্ভরশীল। পরিবারের পক্ষে বেশিরভাগ সময়ই তাদের প্রয়োজন সঠিকভাবে পূরণ করা হয়না বা করা সম্ভব হয় না। তাই রাষ্ট্রকে এই বিষয়গুলোর বিষয়ে নজর রাখতে হবে। তাদের জন্য সকল প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।’ 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলর নিয়োগ ও তদারকি

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে কাউন্সিলর নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলর পদ রয়েছে। আমাদের অনেক স্কুলেই বর্তমানে কাউন্সিলর রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা এটিকে শুধুমাত্র চাকরি হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা শিক্ষার্থীদের ওইভাবে খোঁজখবর নিচ্ছে না। বাচ্চারা কোনো ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে কিনা এ বিষয়ে তারা সঠিকভাবে তথ্য রাখেন না। তাদের দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। এ বিষয়ে রাষ্ট্র এবং নিয়োগকারীকে নিয়মিত তাদারকি করতে হবে।’

এমএইচ/ একেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর