বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি রাজধানীতে, আক্রান্ত ঢাকার বাইরে

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি রাজধানীতে, আক্রান্ত ঢাকার বাইরে

গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর। বিশেষত চলতি সেপ্টেম্বর মাসে এসে ক্রমেই ভয়ানক আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু। ২০২৩ সালের মতো চলতি বছরে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ না করলেও ঢাকা মহানগরীর বাইরে অধিক আক্রান্তের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে। তবে  শতকরা ৫৭ শতাংশ মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে।

চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৩৪২ জন। এর মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ৮ হাজার ৬৯৯ জন। এছাড়া রাজধানীর দুই সিটি এলাকার বাইরে ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগে ১০ হাজার ৬৪৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত ১০৮ জনের মধ্যে দুই সিটিতে ৭২ জন এবং রাজধানীর বাইরে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


গত বছর এই সময় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি সংখ্যা ছিল এক লাখ ৬৪ হাজার ৫৬২, আর মৃত্যু ৮০৪।

তবে গত বছরের আক্রান্তের বিবেচনায় মৃত্যুর হার ছিল দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর চলতি বছরে এ হার দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৪ সালে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু অধিক হয়েছে।

ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি

২০২৪ সালের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বছরের শুরু থেকেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে এর ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা দেখা যায় জুলাই মাসে। আর চলতি মাসে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। শুধুমাত্র সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৬ দিনেই ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬ হাজার ৫০১ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের।


বিজ্ঞাপন


ডেঙ্গুর মাসভিত্তিক আক্রান্তের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৫৫ জন আক্রান্ত ও ১৪ জনের মৃত্যু হয়। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৩৯ ও মৃত্যু ৩, মার্চে আক্রান্ত ৩১১ ও মৃত্যু ৫, এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪ ও মৃত্যু ২, মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ ও মৃত্যু ১২, জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ ও মৃত্যু ৮ জনের মৃত্যু হয়।

এ ধারায় পরিবর্তন আসে জুলাই মাসে। জুলাইয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৬৯ জনে। এসময় মৃত্যু ঘটে ১২ জনের। আগস্টে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৫২১ ও মারা যায় ২৭ জন। আর চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬ হাজার ৫০১ জন এবং মারা গেছেন ২৫ জন।

আক্রান্তের এলাকাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫ হাজার ২৮ জন রোগী ভর্তি হয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। ৪ হাজার ৭১১ জন ডেঙ্গু রোগী নিয়ে পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩ হাজার ৫০৭ জন, ঢাকা বিভাগে ২ হাজার ২২ জন, বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৯১২ জন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৫ জন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ৩ জন, খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৩৬৯ জন, ময়মনসিংহে ৩৯৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৩২ জন, রংপুর বিভাগে ১০৬ জন, সিলেট বিভাগে ১১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এদিকে মৃতের তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে, যা মোট মৃত্যুর ৫৭ শতাংশ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১০ জন, বরিশালে ১০ জন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১৬, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৬, ঢাকা বিভাগে ৩ জন, খুলনায় ৫ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১৯ হাজার ৩৪২ জন। যাদের মধ্যে ৬২ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৯০ শতাংশ নারী। আর এখন পর্যন্ত মৃত ১০৮ জনের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী এবং ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ পুরুষ। অর্থাৎ আক্রান্ত কম হলেও মৃত্যু হার বেশি নারীদের।

Dengue_Dhaka_and_Outside--1

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

মৃত্যুর বিষয়ে জানতে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বেশকিছু বায়োলজিক্যাল কারণ রয়েছে। ডেঙ্গুর চারটি টাইপ রয়েছে। এর মধ্যে টাইপ-থ্রি মারাত্মক রকমভাবে সংক্রমণ ঘটায়। যাদের টাইপ-থ্রি দ্বারা সংক্রমণ হয়, তাদের কারও কারও জটিলতা দেখা দিতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আক্রান্ত হওয়ার পর ম্যানেজমেন্ট বিষয়টি জরুরি। যাদের ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হয় তাদের ভালো ও দ্রুত ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন। বিশেষত যাদের আইভি ফ্লুইডের সমস্যা হয় তাদের অতিদ্রুত হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন। এ পরিস্থিতিটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর শুরু হয়। জ্বর ছেড়ে গেলে রোগীরা ভাবেন তারা এখন ভালো। কিন্তু ওই সময়টাতেই জটিলতা শুরু হয়। তারা যদি হাসপাতালে আসতে দেরি করেন, তাহলে তরল সংকটে রক্ত না পেয়ে অর্গানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন আইসিইউ সাপোর্ট দিয়েও রোগীকে বাঁচানো যায় না।

বর্তমানে ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে থেকে রাজাধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগী বেশি আসছেন। এ অবস্থায় আসার সময় দেরি হওয়ায় কারও কারও জটিলতা বাড়ছে, তখন বাঁচানো যাচ্ছে না বলেও জানান প্রখ্যাত এই সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ঢাকা মেইলকে বলেন, ডেঙ্গু ঢেউয়ের মতো। গত বছর একটা বড় ঢেউ গেছে, এ বছর একটু কম হবে। চারজন মানুষ বিবেচনা করে ধরি, দুইজন অতীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গুর চারটা সেরোটাইপ আছে। এর মধ্যে যে সেরোটাইপটি বর্তমানে সার্কুলেটেড ওই দুই ব্যক্তি যদি তাতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে নতুন করে আক্রান্ত হবেন না। কেননা তার শরীরে ইতিমধ্যে এর বিপরীতে এন্টিবডি আছে। চারজনের বাকি দুইজনের আক্রান্ত হলেও প্রথম দুইজন আক্রান্ত হচ্ছে না। ফলে ছড়ানোর সম্ভাবনাটা কমে গেছে। গত বছর বেসরকারিভাবে ঢাকাতে ১০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি হিসেবে এটা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। ২০০০ সাল থেকে ঢাকার প্রায় অর্ধেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে চান্স অব ইনফেকশন ঢাকায় কমে গেছে। ফলে ঢাকার বাইরে রোগী বাড়ছে। আমাদের ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে অধিক নজর দিতে হবে।

এ সময় আমাদের সারা বংলাদেশকেই টার্গেট করে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই কাজটি স্থানীয় সরকারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে করতে হবে। এই কাজটির মূল দায়িত্ব জেলা প্রশাসনকে নিতে হবে।

Dengue_Dhaka_and_Outside--2

নারীদের মৃত্যু হার বেশি কেন?

জানতে চাইলে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, লিঙ্গগতভাবে ডেঙ্গুতে নারীদের অধিক মৃত্যুর কোনো বিশেষ কারণ পাওয়া যায়নি। করোনার সময় মহিলারা কম আক্রান্ত হতো। এর কারণ আমরা জানি। কিন্তু ডেঙ্গুতে মহিলাদের অধিক মৃত্যুর কোনো হরমোনাল কারণ পাওয়া যায়নি। ফলে আমরা আপাতত অবহেলার বিষয়টিই ধরে নিতে পারি। নারীরা অনেক সময় নিজের অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেন না। তারা সংসার ও বাচ্চাদের প্রতি অধিক যত্নশীল থাকেন। অনেক সময় স্বামীরাও স্ত্রীর অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেন না। মহিলা অসুস্থ হলে ভাবেন ‘দেখা যাক’। ফলে পরিস্থিতি জটিল অবস্থায় চলে যায়।

এমএইচ/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর