শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ডেঙ্গু ঝুঁকি: স্বাস্থ্য বিভাগ কতটা প্রস্তুত?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২১ মে ২০২২, ০৯:০২ এএম

শেয়ার করুন:

ডেঙ্গু ঝুঁকি: স্বাস্থ্য বিভাগ কতটা প্রস্তুত?

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অন্যতম প্রধান ঝুঁকি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সংক্রমণ। প্রায় প্রতি বছরই নির্দিষ্ট সময়ে সংক্রামক ব্যাধিটির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সাম্প্রতিক কালে ২০১৯ এবং করোনা মাহামারীর মধ্যেই ২০২১ সালে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। এ সময় কয়েক লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত এবং শতাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় পরিস্থিতি সবথেকে খারাপ ছিল।

২০১৯ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল এক লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। এ সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ এ করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা না হলেও ২০২১-এ সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ এবং মৃত্যুবরণ করেন ১০৫ জন। 

এ বাস্তবতায় এ বছরেও ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ১৯ মে পর্যন্ত সরাদেশে ২৩৪ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যার বড় অংশ চলতি ও গতমাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার আক্রান্তদের বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকায় ভর্তি হয়েছে। ডেঙ্গুর নতুন প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এর অধীনস্থ সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিলে তা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে একে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আখ্যা দিয়ে, এটি প্রতিরোধে জনসেচতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়ার কথা জানিয়েছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সংস্থাগুলো।

dengu-mosha

এডিস মশা ও প্রদুর্ভাব প্রতিরোধে গৃহীত কর্মসূচি 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রাক-মৌসুম এডিস জরিপের তথ্য মতে, ঢাকায় ৯৪ দশমিক ৯০ শতাংশ কিউলেক্স ও অন্যান্য পূর্নাঙ্গ মশা এবং ৫ দশমিক ১০ শতাংশ এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে। অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ২০টি দলের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের ১১০টি স্থানে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মেঝেতে জমানো পানিতে সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, প্লাস্টিক ড্রামে ২১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, প্লাস্টিক বালতিতে ১৪ দশমিক ০৪ শতাংশ, পানির ট্যাংকিতে (সিমেন্ট) ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ফুলের টবে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ, মেটাল ড্রামে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, প্লাস্টিক মগ, পাত্র, বদনাতে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, পানির ট্যাংক (প্লাস্টিক) - ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং অন্যান্য বস্তুতে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


এর মধ্যে নির্মানাধীন ভবনে ৪২ দশমিক ১১ শতাংশ, বহুতল ভবনে ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ একক ভবনসমূহে ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ, সেমিপাকা বা বস্তি এলাকায় ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, এবং পরিত্যক্ত (ফাকা) জমিসমূহে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ মশার লার্ভা পরিলক্ষিত হয়।

এদিকে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে জনসচেতনা তৈরি লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচারণা, ওষুধ ছিটানো, ধোঁয়ার ব্যবহার, লার্ভা বিরোধী অভিযান, এমনকি জরিমানার মতো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

tapos

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধে আগামী ১৫ জুন থেকে চার মাসব্যাপী বিশেষ অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঝুঁকিপূর্ণ ৭ ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করেছে তারা। এ সময় একাধিক স্থানে লক্ষাধিক টাকার জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) ১৭ থেকে ২৬ মে পর্যন্ত চিরুনি অভিযান কর্মসূচি পালনসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। কাজ করছে স্থানীয় সরকারে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহ। 

এ বছর ডেঙ্গু ঝুঁকি কতটুকু?

সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও গত কয়েকদিনে ডেঙ্গু সংক্রমণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় ডেঙ্গু ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। বর্তমানে আক্রান্তদের সবাই ঢাকার, তা নয়। বাইরের হয়তো অনেকে রয়েছেন, যারা ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছেন। রোগীদের প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। ফলে কারো পরিস্থিতি জটিল হয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি। তবুও একটা আশঙ্কা থেকে যায়। এ আশঙ্কা থেকে যদি সবাই সচেতন হয় তাহলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে না। সবাই যার যার জায়গায় সচেতনভাবে কাজ করলে বর্তমান সংখ্যাটাও কমে আসবে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক নয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তাদের মশক নিধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের কাজের ধারা চলামান থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করি। আমরা চাইবো স্থানীয় সরকার এবং সিটি করপোরেশনগুলো মশা মারার কাজটুকু অন্তত ঠিকমতো করুক। যেনো মানুষ নিরাপদ থাকে।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে যেগুলোতে সংক্রমণ বাড়বে, আবার কিছু ক্ষেত্রে কমবে। যেমন: যদি থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়, তবে বিভিন্ন স্থানে পানি জমবে। এতে সংক্রমণ বাড়তে পারে। বিভিন্ন বাসা বাড়ির জমা পানি, কনটেইনার, রাস্তায় পড়ে থাকা ড্রাম ইত্যাদিতে জমা পানি যদি স্থানীয় সরকার বা সিটি করপোরেশন জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরাতে না পারে তাহলে লার্ভার জন্ম হবে। আবার এসব লার্ভা যদি শনাক্ত করে সঠিকভাবে নিধন না করা হয় তাহলেও সংক্রমণ বাড়বে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্থানীয় সরকার ও তার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর। সিটি করপোরেশন যেসব কর্মসূচি পরিচালনা করছে তা যদি চলমান রাখে এবং জনগণকে সচেতন করতে পারে তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হওয়া রোধ করা যাবে। সারাদেশেই এ ধরনের কাজ করতে হবে। যদি জনগণকে সঠিকভাবে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে তা ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদে কাজে দেবে।’

atik

স্বাস্থ্য বিভাগ কতটা প্রস্তুত?

জানতে চাইলে অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সকল প্রস্তুতি রয়েছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের ডেঙ্গু কর্নারগুলোকে অ্যালার্ট করা আছে। তাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখন রোগীর সংখ্যার উপর ব্যবস্থাপনা নির্ভর করবে। যেমন: করোনা রোগী না থাকলেও কোভিড ইউনিটগুলো স্বল্প আকারে রয়েছে। কোভিড ও নন-কোভিডের মধ্যে সমন্বয় করা হচ্ছে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আমরা চাইবো রোগীর সংখ্যা যেনো কম থাকে।

ঢাকার বাইরের প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাইরের বড় শহরগুলোতে, যেখানে আমরা রোগী পেয়েছি—তাদের সবার কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাদেরকে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা স্থানীয়ভাবেও যেকোনো পরিকল্পনা নিতে পারবেন।’

dr
 
প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে জানিয়ে অধ্যাপক বেনজির বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের ভূমিকা। তাদের সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু রোগীদের প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করতে হবে। এটি জীবন বাঁচাবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ডেঙ্গুর বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আনেক চিকিৎসক ও নার্স নতুন এসেছেন। তারা হয়তো অতীতে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে তারা এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষিত না। তাই ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। ডেঙ্গু সংক্রান্ত গাইডলাইন আপ টু ডেট এবং চিকিৎসকদের সহজে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। রোগীদের সঠিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করতে হবে। শুধুমাত্র প্লাটিলেট কাউন্টে হবে না। অন্যান্য প্যারমিটারগুলোও পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষাগুলো সহজলভ্য করতে হবে।’ 

জটিল রোগীদের জন্য ডেঙ্গু রেফারেল সেন্টার চালুর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘জটিল রোগীদের জন্য ডেঙ্গু রেফারেল সেন্টার মতো ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেখানে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ চিকিৎসা হবে। এখানে ডেঙ্গুরোগীদের সাধারণ জটিলতার পাশাপাশি অন্যান্য জটিলতার চিকিৎসা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। যেনো এমন হয় যে, এখানে যেকোনো অবস্থায় রোগী আনলে তার মৃত্যুরোধ করা যাবে।’

এ লক্ষ্যে ঢাকার বড় হাসপাতালগুলোকে যদি এই আঙ্গিকে প্রস্তুত করা যায় তাহলে সমগ্র ঢাকা কাভার হয়ে যাবে বলে মনে করেন এই প্রখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ।  

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর