মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় উদ্বেগ, মৃতের সংজ্ঞা সংশোধনের দাবি

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২৪ মার্চ ২০২৪, ১২:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় উদ্বেগ, মৃতের সংজ্ঞা সংশোধনের দাবি
  • দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৩,০১,৫৬৪
  • আক্রান্তের তালিকায় ২,৪৩৭ রোহিঙ্গা 
  • ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত ২,৭২৯ জন
  • এখন পর্যন্ত মৃত্যু প্রায় ৪২ হাজার

বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা যক্ষ্মা বা টিউবারকুলোসিস (টিবি)। বিশ্বের মোট ৩০টি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে বর্তমানে তিন লাখ এক হাজার ৫৬৪ জন যক্ষ্মা রোগী রয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৪৩৭ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও রয়েছে। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মাকে গ্লোবাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ সরকার ও কিছু বেসরকারি সংস্থা দেশে যক্ষ্মার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এত উদ্যোগের মধ্যেও উদ্বেগ ছড়াচ্ছে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর)। দেশে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৭২৯ জন। যা মোট রোগীর শতকরা ১ শতাংশ।


বিজ্ঞাপন


সরকারি হিসেবে, ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় প্রতি লাখে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেটি কমে হয়েছে ২৫ জন। সে হিসাবে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৪২ শতাংশ কমেছে। তবে মৃত্যুর এ সংখ্যাটি সঠিক নয় দাবি করে যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংজ্ঞা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।

যক্ষ্মার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, ওষুধ প্রদান এমনকি রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্যও সরবারহ করছে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিনামূল্যে যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণ ও তাদের চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে এসে ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা মুক্ত বাংলাদেশে গড়ে তোলার লক্ষ্য সরকারের।

সরকারি হিসেবে, ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় প্রতি লাখে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেটি কমে হয়েছে ২৫ জন। সে হিসাবে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৪২ শতাংশ কমেছে। তবে মৃত্যুর এ সংখ্যাটি সঠিক নয় দাবি করে যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংজ্ঞা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যক্ষ্মায় আক্রান্তদের শতকরা ৯৮ শতাংশ চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছেন। সে হিসেবে মৃতের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। যক্ষ্মা রোগীদের ক্ষেত্রে জীবিত কিনা শুধুমাত্র তা হিসেব করা হয়। ফলে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকেও যক্ষ্মায় মৃত্যু হিসেবে করা হয়। এদিকে শনাক্তের বাইরে থাকা রোগী কিংবা যারা চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ করে না, তাদের জন্য ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার গাইডলাইন অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি (ছয় মাস) ওষুধ খাওয়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


3

যক্ষ্মা প্রতিরোধে যত উদ্যোগ

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় রোগ নির্ণয়ের জন্য সারাদেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে জিন এক্সপার্ট মেশিন, ট্রুনাট মেশিন, এলইডি মাইক্রোস্কোপি, লিকুইড কালচার, এলপিএ, ডিজিটাল এক্স-রে সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়াও একটি ন্যাশনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি ও পাঁচটি রিজিওনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরির মাধ্যমে জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করা হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে ২০২৩ সালে ২ হাজার ৭২৯ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

সরকারি ৪৪টি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, সাতটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ অর্ন্তবিভাগ ও বর্হিবিভাগ এবং এনজিও ক্লিনিকে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের পর প্রতিটি রোগীকে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি নিয়মিত ওষুধ সেবন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি রোগীর সাথে একজন ‘ডটস প্রোভাইডার নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে যক্ষ্মা কর্মসূচিতে কাজ করা দায়িত্বশীলরা।

নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে

দেশে যক্ষ্মা পরিস্থিতি ও ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. সেরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে যক্ষ্মা প্রতিরোধে সকল ধরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন কমে আসছে। আমরা সববয়সী যক্ষ্মা রোগী পাচ্ছি। তবে তরুণদের মধ্যে এ হারটা বেশি। কারণ তাদের সচেতনতার ঘটতি রয়েছে। একইসঙ্গে তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার অনেক বেশি যা ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, যক্ষ্মার এলাকাভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে নেই। তবে সাধারণত যেসব এলাকা দরিদ্র, খাদ্যের পুষ্টিমান কম এবং জীবনযাত্রার মান খারাপ তাদের যক্ষ্মা কিছুটা বেশি হয়। সেক্ষেত্রে একইসাথে অনেক লোক বসবাস করে তেমন মানুষরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একইরুমে যখন ৪ থেকে ৫ জন থাকে এবং তাদের মধ্যে কারো যদি কেউ অশনাক্ত অবস্থায় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় তাহলে বাকিরাও রোগটিতে আক্রান্ত হয়। 

দেশে অন্তত দুই থেকে পাঁচ শতাংশ ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, নিয়মিত ওষুধ না খাওয়ার কারণে যক্ষ্মা রোগীরা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যান। এমন রোগী প্রথম দিকে বেশি পাওয়া যেত। এখন ওষুধ খায়নি এমন রোগীও ওষুধ প্রতিরোধী টিবিতে আক্রান্ত হচ্ছে। যাকে প্রাইমারি এনডিআর বলে। তারা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। আমাদের ধারণা দেশে যত টিবি রোগী আছেন তাদের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী রোগী শতকরা দুই থেকে পাঁচ ভাগ। আমাদের এখানে বর্তমানে ৬০ জনের মধ্যে ভর্তি আছে। শিশু এনডিআর অনেক কম। আমরা ৪ বা ৫টা কেইস পেয়েছি।

5

থাকতে পারে সুপ্ত অবস্থায়, সচেতন হওয়ার তাগিদ

ডা. মো. সেরাজুল ইসলাম জানান, তাদের ধারনা অনুযায়ী দেশে ১০ শতাংশ সুপ্ত অবস্থায় যক্ষ্মা রয়েছে। অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত না হলে বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে তা মৃত্যু পর্যন্ত প্রকাশ পায় না। তবে পুষ্টিমান কমে যাওয়া এবং অন্য রোগ দেখা দিলে তাদের টিবি দেখা দিতে পারে। অনেকে পজেটিভ হলেও তাদের ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় সরকার তাদেরও ওষুধের আওতায় আনার বিষয়ে চিন্তা করছে বলে জানান তিনি।

সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, যক্ষ্মার লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এর সকল ওষুধ সরকার বিনামূল্যে দেয়। এমনকি ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার ক্ষেত্রে খাবারও সরকার দিয়ে থাকে। তাই লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। এতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।

মৃতের সংখ্যা সঠিক নয়

এদিকে দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর যে তথ্য দেওয়া হয় তা সঠিক নয় বলে বলে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের মধ্যে অন্যতম জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিভাগীয় পরামর্শক ডা. আহমেদ পারভেজ জেবিন। তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড টিবি রিপোর্ট-২০২৩ অনুযায়ী, যক্ষ্মায় বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৪২ হাজার। তবে প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংখ্যাটি আরও কম। এটি কোনোভাবেই ৭ হাজারের বেশি নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো যক্ষ্মা রোগী যদি ওষুধ চলাকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করে তাহলে তা যক্ষ্মায় মৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এসব মৃত্যুর একটা বড় কারণ কোমরবিডিটি। এসব রোগী যদি ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ বা সিকেডি (ক্রণিক কিডনি ডিজিজ) থাকে এবং ওইসব কারণে তার মৃত্যু হয় তাহলে তা যক্ষ্মায় মৃত্যু বলে গণ্য হয়। এমনকি কোনো যক্ষ্মা রোগী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও তা যক্ষ্মায় মৃত্যু হিসেবে চিহিৃত হয়। এটি দূর করতে মৃত্যুর সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকভাবে পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। 

ডা. সেরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যায় কিছু গড়মিল রয়েছে। যক্ষ্মা রোগীদের ক্ষেত্রে রোগী জীবিত অথবা মৃত হিসেব করা হয়। ফলে কোনো রোগী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও তা যক্ষ্মায় মৃত্যু হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এজন্য দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু হার বেশি। আমরা বলছি ৯৮ শতাংশ যক্ষ্ম রোগী চিকিৎসসায় সুস্থ হচ্ছে। তারমানে যক্ষ্মায় মৃতের সংখ্যা এত বেশি না।

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর