মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কৌতূহলের আগুনে পুড়ল ৩২ জন!

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৯:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

কৌতূহলের আগুনে পুড়ল ৩২ জন!

গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নারী-শিশুসহ ৩২ জন দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের অর্ধেকের শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। রয়েছে শতভাগ বার্ন রোগীও। ঘটনার পর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি সকল রোগীই শঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। ইতোমধ্যে ভায়বহ এ দুর্ঘটনার আহতদের চিকিৎসার সকল খরচের দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনা অনেকটাই নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সবগুলো ঘটনার পেছনেই থাকে অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনা। তবে কোনাবাড়ীর ঘটনাটাই কৌতূহলকেই প্রধান দায়ী মনে করছেন আহতদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। একইসঙ্গে ঘটনায় দায় নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য।


বিজ্ঞাপন


বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) সরেজমিনে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে একাধিক রোগীর স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

স্বাজনরা জানায়, এ ঘটনায় আহতদের বেশিরভাগই সিলিন্ডারজনিত সমস্যা দেখতে ঘটনাস্থলে ছিল। তাদের কেউ কেউ সিলিন্ডারটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। আবার ইফতারে আগ মুহূর্ত হওয়ায় অফিস শেষে বাসায় ফেরা পথচারীরাও ছিল। তবে বড় অংশই কৌতূহলী এলাকাবাসী বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের।

আহতদের অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত পরিবার

কোনাবাড়ীর ঘটনায় দগ্ধদের মধ্যে অন্যতম ১১ বছর বয়সী নাঈম। শঙ্কাজনক অবস্থায় শেখ হাসিনা বার্নের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন শিশুটি। তার শারীরিক অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ সে বিষয়ে এখন অন্ধকারে তার পরিবার। এখনও ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি তার মা খুশি বেগম। আইসিইউয়ের সামনে খুশি বেগমের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইফতারের ১০ মিনিট আগে এই ঘটনা ঘটেছে। আমি ও আমার স্বামী তখন অফিসে ছিলাম। আমরা দুইজনই গার্মেন্টসে কাজ করি। অফিস থেকে এসে শুনি আগুন লেগেছে। কাকে কোন দিকে নিয়ে গেছে কেউ কিছু বলতে পারে না। প্রথম সবাইকে কোনাবাড়ী নিয়ে গেছিল। সেখানের হাসপাতালে রাখেনি। পরে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সবাইকে এখানে নিয়ে আসছে। তবে কোনো স্বজন ও অভিভাবককে সাথে আসতে দেয়নি। আমরা জানিও না আমাদের ছেলে কই আছে। পরে টিভিতে খবর দেখে আমরা এখানে এসেছি।’


বিজ্ঞাপন


5

নাঈমের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তার অবস্থা কি আমরা এখনও জানি না। ডাক্তাররা বলেছিল, ২৪ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। এখন আমরা তাদের অপেক্ষায় আছি। ভেতরে কয়েকবার গেছি, ওর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ করে রাখছে। মুখ, দুই হাতসহ সারা শরীর পুড়ে গেছে। আমার সাথে অল্প কথা হয়েছে। বলছে, আমি এখানে থাকব না। আমার খুব জ্বালাপোড়া হচ্ছে। চিৎকার করে কান্না করছে। গতকাল থেকে কিছু খায়নি। এখন ভাত খেতে চাচ্ছে কিন্তু কোনো খাবার দিচ্ছে না। এখন আবার ড্রেসিং করবে। এরপর হয়তো আমাদের জানাবে।’

এদিকে পাঁচ স্বজন নিয়ে হাসপাতালে রয়েছেন অপর নারী ময়ূরী আক্তার। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আগুন লাগার সময় তার পাশেই আমার ভাই দাঁড়ানো ছিল। সে এখন আইসিইউতে ভর্তি। তার নাম মহিদুল। এছাড়া আমার ভাইয়ের বউ নার্গিস, বোন শিল্পী ও তার দুই ছেলে নুর নবী ও নীরবসহ মোট পাঁচ জন পুড়ে গেছে। একজন ছাড়া বাকিরা ওয়ার্ডে আছে চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের কারো অবস্থায় ভালো না। ডাক্তাররা এখনও কিছু বলছে না। এদের মধ্যে সব থেকে খারাপ অবস্থা আমার ভাইয়ের।

ঘটনার সূত্রপাত ও দায় নিয়ে ধোঁয়াশা

ঘটনা প্রসঙ্গে নাঈমের মা খুশি বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি তখন ওইখানে ছিলাম না। তবে যারা ছিল তাদের কাছে শুনেছি সিলিন্ডারের রেগুলেটরে সমস্যা ছিল। রান্না করার সময় গ্যাস বের হচ্ছিল। ওই বাড়ির মহিলা রান্না করছিল। গ্যাস বের হচ্ছে দেখে তাকে সবাই মানা করছে, আগুন না জ্বালানোর জন্য। সে কারো কথা না শুনে আগুন জ্বালিয়েছে। এতে ঘরের ভেতর আগুন জ্বলে যায়। তখন ঘর বাঁচাতে সে সিলিন্ডার বাইরে ফেলে দেয়। আগুনের ঘটনা দেখতে আসে পাশের সবাই ওই ঘরের সামনে জড়ো হয়েছিল। সিলিন্ডার বাইরে ফেলে দেওয়ার পর ওইখানে থাকা সবাই জ্বলে গেছে।

6

এলাকার অবস্থার বর্ণনা দিয়ে এই নারী বলেন, এখানে সবই টিনশেড বাসা ছিল। সবগুলো ঘর একদম কাছাকাছি, শুধু চিপা গলির দিয়ে আলাদা আলাদা করা। যে ঘরে ঘটনা ঘটেছে আমরা তার বিপরীত থাকি। ওইটা মালিকের ঘর। আমাদের ঘর থেকে তাদের ঘর দেখা যায়। ঢিল দিয়ে গ্যাসের সিলিন্ডারটা আমাদের টয়লেটের পাশে এসে পড়েছিল। এরপরই মানুষের শরীরে আগুন লাগে। যে বাসায় আগুন লাগছিল সেই বাসার কোনো ক্ষতি হয়নি। সব অন্য বাসার লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঘটনার জন্য সিলিন্ডার ঢিল দেওয়া ব্যক্তি ও আগুন জ্বালানো মহিলাকে নারীকে দায়ী মনে করেন খুশি বেগম।

আবুল হাসেম নামক অপর ব্যক্তি বলেন, এখানে ৫-৬টি গলি আছে। এর মধ্যে ৩২ থেকে ৩৫টার মতো ঘর। যার ঘরে আগুন লেগেছিল তিনি বাড়িওয়ালা। এই ঘরগুলো বাঁচাতেই বাইরে সিলিন্ডার ছুড়ে মারছে। যার সিলিন্ডারের কারণে এই ঘটনা তার কিছুই হয়নি। তারা ঘর বাঁচাতে সিলিন্ডার বাইরের ছুড়ে মারছে। এতে ‘কি হয়েছে’ দেখতে যাওয়া লোকজনের ক্ষতি করছে। এমনকি কারো ঘরের ক্ষতি হয়নি। যারা ওইখানে দেখার জন্য গেছিল বা গলিতে ছিল তারা সবাই আগুনে পুড়েছে।

4

তবে ভিন্ন মত ময়ূরী আক্তারের। তার ভাই শফি এই ঘরগুলোর ঠিকাদার মালিক। তারা সকলে এখানেই থাকেন। যার মধ্যে পাঁচ দগ্ধ হয়েছে। তিনি এ ঘটনায় তার ভাইকে নির্দোষ দাবি করে জড়ো হওয়া মানুষদেরই দায়ী বলছেন। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের ঘরে সিলিন্ডারের গ্যাসের চুলায় রান্না হচ্ছিল। রান্নার মাঝেই গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন সিলিন্ডার নিয়ে আসে। কিন্তু গ্যাসের ‘লাইজা’ লাগানোর সময় কোনো সমস্যা হয়েছিল। রুমের মধ্যে গ্যাস বের হচ্ছিল। তখন আমার ভাই, ‘ইরি মারে আমি মরলাম, এই লাইজার লাগাইতে লইয়া মরলাম’ বলে সিলিন্ডার নিয়ে বাইরে বের হয়। আমার ভাইয়ের পুরো শরীর গ্যাস দিয়ে মাখামাখি হয়ে গেছিল। তখন সে গ্যাসের বোতল গড়া দিয়ে ফেলে, সে তার মতো চলে গেছে। তখন সেখানে কোনো মানুষ ছিল না। 

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, পাশেই আমাদের ভাড়াটিয়া মুক্তি পাশে লাকড়ির চুলায় রান্না করছিল। তখনও সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। তখন আমি তাকে মানা করছি চুলা না জ্বালাতে সে শুনেনি। আশেপাশের সবাই মনে করেছে গ্যাস পুরোটা গেছে, আর কোনো সমস্যা নাই। তখন সবাই সিলিন্ডারকে ঘিরে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন লাকড়ির চুলার থেকে আগুন এসে সবার গায়ে আগুন লেগেছে। সবাই তখন যে যার মতো চিৎকার দিয়ে দৌড়ে গেছে। ওইখানে অনেক লোক ছিল। আমি কত মানুষরে আগুন থেকে বাঁচাইছি কিন্তু আমার ভাই আর ভাইয়ের বউকে বাঁচাতে পারিনি। ইফতারের সময়, সবার ছুটি হয়েছে ফলে রাস্তায় ভিড় ছিল। যারা ওইখানে ছিল, তাদের বাইরে পথচারীও পুড়েছে। 

ভাইকে নির্দোষ দাবি করে ময়ূরী বলেন, ‘দোষ যারা দেখছিল, আর যে চুলা জ্বালিয়েছিল। তারে বারবার বলেছি। সে শুধু বলেছে কোনো সমস্যা হবে না। আমার ভাই তো শুধু গ্যাসের সিলিন্ডার গড়াগড়ি দিয়ে ফেলেছে। তখন সেখানে কোনো মানুষও ছিল না। তার কোনো দোষ নাই।’

এমএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর