ঢাকার জাতীয় শিশু হাসপাতালে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র আছে হাতে গোনা কয়েকটি। ফলে এই আইসিইউ এ সিট পেতে প্রথমে সিরিয়াল দিতে হয়। আর সেই সিরিয়াল ধরে সিট পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় রোগীর স্বজনদের। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। কিন্তু বাড়ানো হচ্ছে না আইসিইউ এর সংখ্যা।
ঢাকার নিকটবর্তী একটি উপজেলা থেকে ভাতিজা সুমনকে নিয়ে এসেছেন চাচা আহমেদ আহনাফ (ছদ্মনাম)। টানা চব্বিশ ঘণ্টা বিভিন্ন জায়গায় তদবির করে অবশেষে পেয়েছেন আইসিইউ। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, সেখানে আসলে আইসিইউ পাওয়া বড্ড কঠিন। আর এখন তো ডেঙ্গুর সময় চলছে। এ কারণে অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর স্বজনরা সেখানে কোনো আইসিইউ পাচ্ছেন না। যেকটা আছে তাও আগে থেকে বুক করা থাকছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, তার ভাতিজার জন্য আইসিইউ দরকার ছিল। কিন্তু পাচ্ছিলেন না। অনেক কষ্টে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফোন দিয়ে তদবির করে অবশেষে পেয়েছেন। এখনো তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তিনি বলছিলেন, তার ভাতিজার জন্য এই সিট পেতে তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বড় মাপের রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাকে দিয়েও ফোন করিয়েছেন। তবে মিলেছে এই সিট। তার মতে, হয়ত অনেকের এই সামর্থ আছে, কিন্তু যাদের বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফোন করার সামর্থ নেই তারা নীরবে এই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। আর পথে যেতে যেতেই প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে ফেলছেন তারা।
মঙ্গলবার সারাদিন হাসপাতালটিতে অবস্থান করে ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে এমন সব তথ্য পাওয়া গেছে।
হাসপাতালটিতে আগত রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যারা হাসপাতালটিতে আইসিইউ নিতে আসেন তাদের বেশিরভাগই ঢাকার বাহির থেকে আসা। কারণ জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ হাতে গোনা। ফলে বাধ্য হয়ে সন্তানকে বাঁচাতে ঢাকায় আসেন বেশিরভাগ রোগীর স্বজনরা। কিন্তু শিশু হাসপাতালে এসে সেই কাঙ্খিত আইসিইউটি তারা সহজে পান না। রিক্ত হস্তে তাদেরকে ফিরে যেতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
স্বজনরা বলছেন, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সবকিছু এগিয়েছে, কিন্তু চিকিৎসা খাতের তেমন উন্নয়ন হয়নি। বিভিন্ন হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়লেও শিশু হাসপাতালের সিট ও আইসিইউ এর সংখ্যা বাড়েনি। এখানে এসে আইসিইউ না পেয়ে অনেককে সন্তানের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। আর প্রতিদিন ভারি হচ্ছে এই মিছিল। যদিও হাসপাতালটির জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল হাকিমের দাবি, গত এক বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
আইসিইউ এর সিরিয়ালেও দুর্নীতি!
ভুক্তভোগীরা বলছেন, শিশু হাসপাতালে আইসিইউ হাতে গোনা। ফলে সেখানে যেকেউ খুব সহজে আইসিইউতে সিট পায় না। সিটের জন্য তালিকায় নাম লিখিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়। যখন সিরিয়াল আসে তবেই সিট মেলে। তবে তার আগেই অনেকের সন্তান এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। আবার কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে সন্তানের জীবন রক্ষায় অন্য হাসপাতালে ছোটেন। যদিও অন্যত্র আইসিইউ পেতে মোটা অংকের টাকা গুনতে হয় ভুক্তভোগীদের।
শিশু হাসপাতালে অনেকেই আইসিইউ এর জন্য তালিকায় নাম ওঠান। কিন্তু শেষমেষ হাতে গোনা ক'জন পান সেই আইসিইউ। আর এই আইসিইউ যারা পান তাদেরও নানা কৌশলে দেওয়া হয়। সেই কৌশলটা কিরকম জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক রোগীর স্বজন বলেন, প্রতিদিন শতাধিক ব্যক্তির নাম তালিকায় থাকে। কিন্তু সেখান থেকে যাদের নামের তালিকায় শতাধিক পার হয়ে যায় তাদের নামের সংখ্যার জায়গায় ৩, ৪ বা ৫ লিখে এগিয়ে রাখা হয়। এরপর তারাই পেয়ে যান সেই সিট।
তিনি আরও বলেন, কাউকে সিট থেকে বের করে দেওয়া হয় না। মূলত কৌশলে ধরেন কারও সিরিয়াল নম্বর-৯৯। তার সংখ্যার আগে ২, ৩ বা ৪ লিখে সিরিয়াল কমিয়ে দেওয়া হয়। যাতে বিষয়টি অন্য রোগীর স্বজনরাও ধরতে না পারে। আর সেই রোগীর স্বজনকে আগে থেকে পাওয়া নম্বরটি কারও সাথে শেয়ার না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। যখন তারা আইসিইউ পেয়ে যান, তখন কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলেন আমাদের নাম তালিকায় সবার ওপরে ছিল। আর এই কাজে হাসপাতালটির আইসিইউ এর তালিকা প্রস্তুতকারী ব্যক্তিরা জড়িত। এর বিনিময়ে তারা রোগীর স্বজনদের কাছে বিভিন্ন অংকের টাকাও নেন। এভাবেই আইসিইউতে সিট পাইয়ে দিতে দুর্নীতি করেন হাসপাতালটির সেই বিভাগের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। তবে কোনো শিশুকে কখনোই আইসিইউ থেকে বের করে দেওয়া হয় না। চিকিৎসকরা তা করেন না। একটি খালি হলে সেটার জন্য দুর্নীতি করে দূরের সিরিয়ালের সংখ্যা কমিয়ে সেই রোগীকে সিট দেওয়া হয়।
গত সপ্তাহে হাসপাতালটিতে তার ভাতিজাকে নিয়ে এসে থেকে এমন অভিজ্ঞতার কথা তিনি শেয়ার করছিলেন ঢাকা মেইলের সাথে।
কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে এসেছেন রুবেল সরকার। তিনি জানান, তার শিশুর অবস্থা খুব ভালো না। তবে আইসিইউতে রাখতে পারলে আরও ভালো হতো। কিন্তু তিনি সেটি পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, এই আইসিইউতে ফ্রি চিকিৎসা সেবা সুবিধা থাকলেও তা গরিবরা পান না। অনেক ধনী ব্যক্তিরা বিনা টাকায় তাদের সন্তানদের জন্য আইসিইউ সেবা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টি অনেকেই জানেন না। আমি এখানে এসে জানলাম কিন্তু আমরা সেই সেবার সুযোগ পাইনি।
এ বিষয়ে শিশু হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এখানে আইসিইউ কোনো ধনী, গরীবের পার্থক্য করে বন্টন করি না। যিনি আগে আসেন তাকেই দিয়ে থাকি। আমরা এনআইসিইউ, আইসিইউসহ বাকীগুলো বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। আগামী বছর থেকে এগুলো বাড়বে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমরা এখানে যাদের ফ্রি বেড দেই তাদেরকে ফ্রি ওষুধ ও খাবারও দেই। তবে সব ওষুধ তো দেওয়া সম্ভব হয় না। কিছু ওষুধতো বাহিরে থেকে কিনতেই হবে।
এমআইকে/এমএইচএম

