বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কবির স্মৃতি ভেঙে ফেলার আগে কেউ একটিবার ভাবল না: খিলখিল কাজী

রাফিউজ্জামান রাফি
প্রকাশিত: ২৫ মে ২০২৩, ১১:২২ এএম

শেয়ার করুন:

বল বীর— বল উন্নত মম শির! শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির! কিংবা আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে— মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে— পঙক্তিগুলো মনে পড়লেই মানসপটে ভেসে ওঠে ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। একাধারে প্রেম, সাম্য, দ্রোহ ও মানবতার কবি তিনি।

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ কবির জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের এই বরপুত্র। এ উপলক্ষে ঢাকা মেইল মুখোমুখি হয়েছিল কবির নাতনি ও নজরুল সংগীতশিল্পী খিলখিল কাজী। কথোপকথনে উঠে এসেছে কবিকে নিয়ে তার ভাবনা, স্বপ্ন ও আক্ষেপের কথা।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশে নজরুলচর্চা ও গবেষণা কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন?

নজরুলকে নিয়ে গবেষণা প্রচার প্রসার যা হওয়ার তা বাংলাদেশেই হচ্ছে। তিনি এ দেশের জাতীয় কবি। তাকে মানুষ ভালোবাসেন। অন্য কোথাও সেভাবে হচ্ছে না। বাংলাদেশে তাকে নিয়ে এতকিছু হচ্ছে দেখে পশ্চিমবঙ্গও নড়েচড়ে বসেছে। বিশেষ করে মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে নজরুল চর্চাটা বেশি হচ্ছে ওখানে। দাদুর (নজরুল) প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। তিনি পশ্চিমবঙ্গে নজরুল ইনস্টিটিউট করেছেন। আর বাংলাদেশে তো আমি যখন ১৯৮৫ সালে চলে আসি তখন নজরুল ইনস্টিটিউট করা হয়। আপনি হয়ত জানেন, দাদু তার ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে সাড়ে চার হাজারের মতো গান লিখেছেন। তিনি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে তাকে নিয়ে চর্চা কমে আসে। কণ্ঠশিল্পীদের কণ্ঠে সুরেরও এদিক সেদিক দেখা যায়। আমি কলকাতায় থাকাকালীন লক্ষ্য করেছি, অনেক বিখ্যাত গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে নজরুলের গান হচ্ছে, কিন্তু দুই দেশে সুরে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এসব এক ছাতার নিচে আনতে নজরুল ইনস্টিটিউট তৈরির পর ট্রাস্টি বোর্ড গঠন হলো, নজরুল সংগীতের আদি সুর সংরক্ষণের বোর্ড গঠন করা হলো। সেখানে ফিরোজা বেগম, সুধীন দাশসহ অনেক মহারথীরা ছিলেন। প্রিজার্ভেশন কমিটি হলো। নজরুলের আদি সুর পশ্চিমবঙ্গ এবং এ দেশে যাদের কাছে ছিল তাদের থেকে নজরুল ইনস্টিটিউট, দেশের সরকার টাকা দিয়ে সংগ্রহ করে। এরপর নজরুলের গানের স্বরলিপির বই প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া নজরুলের অনুবাদ নিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে আমার মনে হয়, অনুবাদ নিয়ে কাজটা আরও করা উচিত। কেননা নজরুল বলেছেন, তার সাহিত্যকর্ম সারা বিশ্বের জন্য। তিনি কোনো নির্দিষ্ট জাতির জন্য নন। তার কবিতা গান প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর। মাত্র ২১ বছর বয়সে বিদ্রোহী কবিতার মতো একটি শক্তিশালী কবিতা রচনা করেছেন। আমার মনে হয় না বিশ্বসাহিত্যে এত শক্তিশালী কবিতা আর আছে। এতবড় একজন কবির সাহিত্যসমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। সেকারণে আমি বলব নজরুল সাহিত্যের অনুবাদ ও গবেষণাটা বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে দেশের বাইরে যারা নজরুল গবেষক আছেন তাদের নিয়ে এসে গবেষণার কাজটি করানো উচিত। আপনি জানেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর ১০০ মার্কসের পেপারস আছে অথচ নজরুলের ওপর ১০ বা ২০ মার্কস আছে কি না আমার সন্দেহ। তো এক্ষেত্রে কীইবা বলার আছে?

আপনি বাংলা সাহিত্যে শিক্ষা সম্পন্ন করবেন নজরুলকে বাদ দিয়েই? এটা সম্ভব? তাকে বাদ দিয়ে কি বাংলা সাহিত্য ভাবা যায়? আমার মনে হয় এগুলো নিয়ে ভাবা দরকার। আমরা চেষ্টা করেছি তাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারিনি সেভাবে। নজরুল সম্পর্কে সবাইকে জানাতে তাকে সকল প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে স্কুল কলেজে নজরুল পাঠ্যক্রম চালু করা উচিত। এখনও তাকে নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী আছে। এ কারণে তার জীবনী সঠিকভাবে করা উচিত। জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কিছুটা করেছিলেন। এরপর আর কেউই করেননি।

Khilkhil Kazi


বিজ্ঞাপন


নজরুলকে নিয়ে গবেষণায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কতটা সন্তোষজনক?

নজরুল গবেষণায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে যে পৃষ্ঠপোষকতা হচ্ছে আমার কাছে তা সীমিত মনে হয়। নতুন প্রজন্মে ভালো ভালো গবেষক তৈরি হচ্ছে। তাদের যদি উৎসাহিত করা যায় তবে আমার মনে হয় তারা নজরুল গবেষণার কাজে এগিয়ে আসবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর একটু বাড়ানো উচিত বলে আমি মনে করি।

নজরুলের সাহিত্য সংরক্ষণ ও প্রসারে নজরুল ইনস্টিটিউট কতটা ভূমিকা রাখছে? আপনি তো সেখানকার ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য। 

নজরুল ইনস্টিটিউটে একসময় অনেক গুণীজন কাজ করেছেন। সেসময় অনেককিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকেও তার হাতে লেখা খাতা গেছে। এ ছাড়াও অনেকের কাছে তার হাতে লেখা খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সরকার থেকে যদি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় অর্থাৎ একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এসব সংরক্ষণের জন্য তাহলে আরও কিছু পাওয়া যেতে পারে। আমরা নিজেরা চেষ্টা করছি। কিন্তু এত বড় কাজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া করা সম্ভব না। 

নজরুলের স্মৃতিরক্ষায় সরকার ও নজরুল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

আমরা তো করেছি। মানিকগঞ্জ, শিমলায় নজরুলের দুটি ইনস্টিটিউটের মতো আছে। সেখানে পাঠাগার আছে, তার বই আছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে তো আছেই। তবে এটুকুই শেষ নয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা রয়ছে। রাজশাহীতেও কবি গেছেন। সেখানে নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেছেন। ২০১৩ সালে বোধহয়। আমিও ছিলাম। এর বাইরে দেশজুড়ে তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যাতে মানুষ জানে তিনি কতবড় কবি ছিলেন। ঢাকা শহরে তো কিছুই নেই নজরুলের। শহরের বিশেষ স্থানগুলোতে তার ম্যুরাল স্থাপন করা উচিত। একুশে টিভির সামনে একটা আছে। কিন্তু সেটা তেমন একটা ভালো হয়নি। ওখান দিয়ে ব্রিজ হয়েছে। মেট্রোরেল হচ্ছে। আমার মনে হয় এই জায়গাগুলোতে দাদুর বাণী রাখা উচিত। শহরের বিভিন্ন বাসস্টপেজে শুধু দাদুর নয়, রবি ঠাকুর, বঙ্গবন্ধুসহ বড় বড় মনীষীদের বাণী এই জায়গাগুলোতে রাখা উচিত। বাসস্টপেজে তো মানুষ বসে থাকে। তারা সেসব পড়বে। বুঝবে এসব আমাদের মনীষীদের লেখা। এবার দাদুর বিদ্রোহী কবিতার শত বছর হলো। আমরা এখনও পালন করছি। ওই বিদ্রোহী কবিতার লাইনগুলো শহরের বিভিন্ন স্থানে যদি থাকত তাহলে সবাই জানতেন এই কবিতা লিখে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু সেসব তো নেই। আছে শুধু প্রাইভেট কোম্পানির বিজ্ঞাপন। ঢাকা শহর বিজ্ঞাপনের শহর হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপনও থাকুক, কিন্তু এই মনীষীদের বাণীও থাকা উচিত। আমাদের দেশ জারি-সারির দেশ, হাছন-লালনের দেশ। এগুলো তো সবাইকে জানাতে হবে। সরকার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। এই দায়িত্বগুলো শহরের মেয়রদের নেওয়া উচিত। কেননা তারা এ দেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে। আর তাদের বহন করবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। এ ছাড়া বিমান বন্দরে নজরুলের একটি ম্যুরাল রাখা উচিত। সেখানে বাংলা ও ইংরেজিতে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থাকবে। তিনি কেন বিখ্যাত— তা থাকবে। আর নজরুল ইনস্টিটিউট নিয়ে আমার কিছু কথা আছে। শহরের অনেক মানুষই জানেন না নজরুল ইনস্টিটিউট কোথায়! এগুলো জানাতে হবে। নজরুল ইনস্টিটিউট হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। শুধুমাত্র অফিসকেন্দ্রিক ইনস্টিটিউট হতে পারে না। আমার আশা ছিল নজরুল ইনস্টিটিউট এমন হবে যেন মানুষ ঢুকেই বুঝতে পারে এটা নজরুলের জায়গা। কক্ষগুলো থেকে নজরুলের গান আবৃত্তি ভেসে আসবে। এসব বলছি কারণ তিনি তো মনীষী। তাকে তো আমাদের ধারণ করতে হবে। আমার বাবা তথা নজরুলের বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর কথাই বলা যাক। কী দারুণ আবৃত্তিকার ছিলেন! শুধুমাত্র বিদ্রোহী কবিতা দিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন। আমার বাবা বলে বলছি না। তারা তো মনীষী। তারা দিতে আসেন, নিতে আসেন না।

Khilkhil

নজরুল বলেছিলেন, আমার সাহিত্যকর্মে আমি কী দিয়েছি জানি না, তবে সংগীতে আমি যা দিয়েছি তা অফুরান। নজরুল সংগীতের প্রসারের কাজটি কতটা সঠিকভাবে হচ্ছে বলে মনে করছেন? 

আমি আগেই বলেছি, নজরুল ইনস্টিটিউট হওয়ার পর আমরা নজরুলের গান সংরক্ষণের কাজ করেছি। যতটা পেয়েছি তার আদি সুর নিয়ে স্বরলিপি করেছি। তারপরও বিভিন্ন জেলা উপজেলায় দেখা যায় শিল্পীরা যখন নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন তখন সুরের হেরফের হয়। তাদেরও তো এ বিষয়ে অবগত থাকতে হবে। নজরুল ইনস্টিটিউটে তার গানের স্বরলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। সে সম্পর্কে আগ্রহ থাকতে হবে। নজরুল তার জীবদ্দশায় সাড়ে চার হাজার গান তৈরি করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলা গজলের প্রবক্তা। তার গান, হামদ, নাত এ দেশের ঘুমন্ত মুসলিমকে জাগিয়েছে। একইভাবে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য শ্যামা সংগীত লিখেছেন। তারপর আর কেউ কিন্তু শ্যামা সংগীত লেখেননি। তেমনিভাবে তার গানে উঠে এসেছে মেহনতি মানুষের কথা। নজরুলের গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতবাসী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নজরুলের গানের ভক্ত ছিলেন। তিনি দাদুর চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন কিন্তু দুজনের মধ্যে ভীষণ সখ্যতা ছিল। বাবার কাছে শুনেছি, নেতাজির জনসভা থাকলেই দাদুকে টেলিগ্রাম পাঠাতেন। তাতে লেখা থাকত, নজরুল আমার জনসভা আছে। তুমি কিন্তু হারমনিয়াম নিতে ভুলো না। ১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে দাদুকে জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওয়াজেদ আলী, বিজ্ঞানী প্রফুল্লাচার্য। বক্তা ছিলেন নেতাজি। তিনি বলেছিলেন, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে আমি ঘুরেছি। তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছি। তাদের জাতীয় সংগীত শুনেছি। কিন্তু নজরুলের একটি ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো গান কোথাও শুনিনি। আমি যখন জেলে ছিলাম তখন ওয়ার্কাররা যখন জেলের গরাদে এসে আঘাত করত তখন আমার ভেতরে আকুলি বিকুলি করে উঠত। মনে হতো, আমাকে নজরুলের গান গাইতে হবে। আমি যখন নজরুলের গান শুনি তখন আমার মতো বেরসিক মানুষের ভিতরেও জোশ চলে আসে।

এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ প্রাণের বলিদান হয়েছে, দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এই ত্যাগের বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর আদেশে সবাই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। আরও অনেক নেতার অবদান আছে এই স্বাধীনতা অর্জনে। এই স্বাধীনতা যুদ্ধেও সাহস জোগাতে ব্যবহৃত হয়েছে নজরুলের গান-কবিতা। এখনও আমরা যেকোনো সংকটে নজরুলের গান ব্যবহার করি, উদ্বুদ্ধ হই। আজকাল পশ্চিমবঙ্গও নড়চড়ে বসেছে। কেননা তারা বুঝতে পেরেছে নজরুলের গান ছাড়া পাত্তা পাওয়া যাবে না।

তবে কিছু জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। আমি কলকাতার টিভি চ্যানেলে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে তাকে বিশেষভাবে স্মরণ করে থাকে। কিন্তু আমাদের চ্যানেগুলোতে যে নিয়মিত নাটকগুলো হয় সেগুলোর নির্মাতারা কি বলেছেন নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে আমার নাটকের এপিসোড বন্ধ রেখে কবিকে বিশেষভাবে স্মরণ করি? জানি এটা করা হয় না। তেমনই চলচ্চিত্রেও নজরুলের গানের ব্যবহার চোখে পড়ে না। আগে পহেলা বৈশাখে দেখতাম দাদুর ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর…’ গানটি হতো। এখন তাও হয় না। আস্তে আস্তে তার গানের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। শুধু ‘চল চল…’ গানটি রয়ে গেছে রণসংগীত হিসেবে। এটি বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। দাদুর প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। তিনি আমাদের ও দাদুকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তার আঙুল উঁচিয়ে ভাষণের ছবিটার সঙ্গে দাদুর ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির…’ লাইনগুলোর মিল রয়েছে। তার সাত মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণের সঙ্গে দ্রোহের জায়গা থেকে বিদ্রোহী কবিতাটির মিল খুঁজে পাই। সম্প্রতি আমার চাচি কল্যাণী ঘোষের মৃত্যু হয়েছে। আমি কলকাতা গেলে তিনি বলেছিলেন, রবি ঠাকুরের জন্মদিনে সারা কলকাতা ছুটি ছিল। আমিও দাদুর জন্মশতবার্ষিকী থেকে এই দাবি করে আসছি। নজরুলের জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা করা হোক। দেশের কুলি-মজুর ছাত্র-ছাত্রী,  শিশু-কিশোর সবাই জানবে, আজ নজরুলের জন্মদিন। তিনি অনেক বড় কবি ছিলেন।

Khilkhil

বিদ্রোহ, প্রেম ও সাম্য— এই বহুমাত্রিক সমন্বয় আপনি কীভাবে দেখেন?

তিনি প্রেমের কবি ছিলেন বলেই তো বিদ্রোহী কবি হতে পেরেছিলেন। প্রেম বলতে তো শুধু প্রেয়সীর প্রেম না। দেশের প্রতি প্রেম, মানুষের প্রতি প্রেম, জীবের প্রতি প্রেম, নীতি-নৈতিকতার প্রতি প্রেম। এসবই তো তার বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া তিনি সাম্যের কবি ছিলেন। আরও অনেক বিশেষণ রয়েছে তার নামের সঙ্গে। তবে আমি তাকে দেখি একজন মানুষ হিসেবে। মানুষ হিসেবে অসাধারণ ছিলেন তিনি। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। কিন্তু ব্যক্তি নজরুলের চর্চা তেমন হয় না। তার বন্ধুরা স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ব্যক্তি নজরুল ছিলেন অসাধারণ। মানুষকে সমান চোখে দেখতেন তিনি। তাকে অনেকে কাফের, যবন ফতোয়া দিয়েছে। কিন্তু তাদেরও তিনি ভালোবেসেছেন। যারা তাকে ঘৃণা করেছেন তিনি তাদের পাঁচগুণ ভালোবেসেছেন। মাটির মানুষ ছিলেন। তার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শোনা যায় সেসব কথা। সরোজবালা দেবী, আঙুরবালা, ইন্দুবালা তার ছাত্রী ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে কাজীদা বলে ডাকতেন। দাদুর ছিল ভীষণ পান ও চায়ের নেশা। তার একটি সিলভারের বাক্স ছিল। সেখানে এক শ একটা পান সাজানো থাকত। একবার এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত চা খাওয়ার কারণ। শুনে কবি বলেছিলেন, চালাক যদি হতে চাও, লাখ পেয়ালা চা খাও। সরোজবালা দেবীর এক স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, একবার নজরুলের এক নাটকে তার গান গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরোজ দেবী তো ভয়ে অস্থির। এত বড় কবির গান গাবেন! সাহস পাচ্ছিলেন না। কিন্তু নজরুল বললেন, তুই পারবি। আমি তোকে শেখাব। দাদু তখন তাকে বললেন, নে একটা পান খা। সরোজবালার মুখে একটি পান গুঁজে দিলেন। সরোজ দেবী বলেন, কী সুগন্ধী যে ছিল সেই পান! এভাবে তার সঙ্গে মিশে গিয়ে সাহস জুগিয়ে গান গাইয়ে নিয়েছিলেন দাদু। এই হলেন ব্যক্তি নজরুল। আমাদের বাবা-চাচাও এমন ছিলেন। মানুষে ভেদাভেদ করতেন না তারা। আমরাও দাদুর এই গুণ পেয়েছি। সব মানুষকে সমান চোখে দেখি।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ— নজরুলচর্চায় দুই বাংলার মধ্যে কোন জায়গাকে আপনি এগিয়ে রাখবেন?

চর্চা বলতে কলকাতায় কী হচ্ছে আমি জানি না! ওখানে একটা নজরুল ইনস্টিটিউট আছে। সেটা সচল আছে কি না জানি না! আমাদের এখান থেকে তারা স্বরলিপি নিয়ে গেছেন, কিন্তু চর্চা কেমন চলছে বলতে পারছি না। সেখানে নজরুলের গানের তেমন কোনো শিল্পী নেই। আধুনিক গানের শিল্পীরাই নজরুল সংগীত গাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে কলকাতার জনগণের মাঝে নজরুল ভীষণ জনপ্রিয়। আমি বলেছিলাম, কলকাতায় একটা সেন্টার করা হোক যেখানে বাংলাদেশের লেখকদের বই যাবে। নজরুলের গানের স্বরলিপি, আমরা যা প্রকাশ করছি সেসব ওখানে পাওয়া যাবে। এটা হলে ওখানে নজরুল চর্চাটা ভালোভাবে হতো। শুধু কলকাতা না ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন জানতে পারবে তার গান কবিতা সম্পর্কে। এগুলো না করলে চর্চা বাড়বে না। কারণ আমি কতক্ষণ ইউটিউব, সিডি দেখে শিখব। আমার তো স্বরলিপি জানতে হবে। এটা চাইলে দুই দেশের সরকার করতে পারে। তবে মমতা বন্দোপাধ্যায় আসার পর নজরুলকে নিয়ে অনেককিছু করেছেন। আসানসোলে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় করেছেন, দুর্গাপুরে তার নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে। কলকাতায়  নজরুলের তীর্থ হয়েছে। আর বাংলাদেশে তো আমরা আছি। নজরুল চর্চা প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে যারা নজরুল সংগীতের চর্চা করছে। আমাদের একটি দল আছে। নজরুল সংগীত সংস্থা। আমি সেখানকার উপ-প্রেসিডেন্ট। আমরা দলটি নিয়ে নজরুল সংগীতের চর্চা করছি। এভাবে আমরা নজরুল চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি।

তবে অনেকেই বলেন, নজরুলের গান নাকি চলে না! এটা ভুল। আমরা নজরুলের গান নিয়ে দুই দিনের উৎসব করি। সেখানে শ্রোতার অভাব হয় না। আমি নিজেই দেখেছি ছোটবেলায় জলসায় বম্বের শিল্পীরা এসে সারারাত দাদুর গান গাইতেন। আমি নিজেও বিভিন্ন দেশে যাই। সেখানে দাদুর গান শুরু করলে থামতেই চায় না। এত শুনতে পছন্দ করেন সবাই!

Nazrul

এইচএমভি থেকে নজরুলের গানের রেকর্ড প্রকাশ পেয়েছিল। গানগুলো এখন কী অবস্থায় আছে? সেগুলো আনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি?

আমরা সব আনতে পারিনি। কারণ অনেক রেকর্ডই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেগুলো ভালো ছিল সেগুলো এনে সংরক্ষণ করেছি। এ ছাড়া কবির কনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধ কাজী রেকর্ডগুলো নিয়ে সেসময় পরীক্ষামূলক কাজ করেছেন। যেসব জায়গায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ঘসঘস শব্দ হয়েছে সেসব জায়গায় তিনি নিজের মতো করে সুর বসিয়েছেন। এভাবে আমরা গানগুলো সংরক্ষণ করেছি।  তবে সব যে পেয়েছি তা বলব না। বেশকিছু পেয়েছি বলেই আমরা স্বরলিপি করতে পেরেছি। এখনও অনেক রেকর্ড ভারতে অনেকের কাছে আছে। সেক্ষেত্রে দুই দেশের সরকার যদি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তবে সেসব সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

দেখবেন, একদিন আসবে যেদিন পৃথিবীর মানুষ নজরুল সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশে আসবে। তাই তাকে নিয়ে আমাদের আরও কাজ করা উচিত। বিশ্বের অনেকে আমার কাছে জানতে চায় দাদুর সম্পর্কে। তাকে নিয়ে এখন কী করা হচ্ছে— সে সম্পর্কে। আমি নজরুল ইনস্টিটিউটের কথা বলেও চুপ হয়ে যাই। কারণ ওখানে অনেক অবহেলা আছে। আজ যদি বঙ্গবন্ধু থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই এটা হতো না। ওনার মেয়েও দাদুর ব্যাপারে খুব উদার। কিন্তু তিনিও তো ব্যস্ত থাকেন। আমার মনে হয় একটি কমিটি করে দেওয়া দরকার। নজরুলের কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না— এটা তদারকি করার জন্য। এটা করা গেলে অনেককিছু করা যাবে। তাই সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ, এই বিষয়টি যেন বিবেচনা করা হয়।

আপনার কল্পনায় একটি নজরুল ইনস্টিটিউট আছে। সেটি নিয়ে কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, নিয়েছি তো। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আমি চেয়েছিলাম নজরুল ইনস্টিটিউটের দুই পাশে যে ভবনগুলো আছে তাদের থেকে জায়গা চেয়ে নিয়ে ইনস্টিটিউটে ঢোকার পথ থেকেই দুই পাশে দাদুর কবিতা টাঙানো থাকবে। আর ভেতরে ঢুকতেই দাদুর গান ভেসে আসবে। আসলে নজরুল ইনস্টিটিউটে নজরুল মনস্ক মানুষ দরকার। যাদের ধ্যান-ধারনায়, চিন্তায়, চেতনায় নজরুল থাকবে। তবেই নজরুল ইনস্টিটিউট এভাবে সাজানো যাবে। আমাকে তো ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য করেই রাখা হয়েছে, আমার যদি কখনও সুযোগ হয় তবে আমি চেষ্টা করব। কিংবা কোনো নজরুলপ্রেমী যদি আসেন তখন হবে।

এ দেশের সবাই আমাদের জাতীয় কবিকে ভালোবাসেন। তার গান কবিতার সঙ্গে তাদের রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক। নতুন প্রজন্মের কাছে কবিকে কী কী উপায়ে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে?

আমদের টিভি চ্যানেলগুলোতে শুধু জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ না করে ১২ মাস নজরুলের গান কবিতা-সাহিত্যকর্ম নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। এ ছাড়া কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে একটি চ্যানেল করা উচিত। সেখানে দেশের বড় বড় মনীষীদের কথা প্রচার করা হবে। এভাবে যদি টিভিতে নিয়মিত তাকে নিয়ে আলোচনা করা যায় তাহলে নজরুলকে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। বাচ্চাদের জন্য নজরুলের জীবনী অ্যানিমেশনের মাধ্যমে এপিসোড আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। তাহলে তারা বেশ আগ্রহসহ কবিকে জানতে পারবে।

Khilkhil

নতুন কোনো জায়গায় গেলে মানুষ যখন জানতে পারেন আপনি নজরুলের নাতনি, তখন তাদের অভিব্যক্তি কেমন হয়?

পাগল হয়ে যায় সবাই। অবাক হয়ে যায়। তারা আমাকে নিয়ে তখন এত মাতামাতি করে যে নিজেকে ভিআইপি বলে মনে হয়। আমার কাছে দাদুর গল্প শুনতে চায়। অনেকে আমাকে ছুঁয়েও দেখতে চায়।

নজরুল ঢাকায় ধানমন্ডির যে ভবনটিতে থেকেছেন, সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। আপনার কাছে কী মনে হয়, এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সংস্কার করে আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে দেওয়া যেত?

আমার খুব আফসোস হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত কাঠামো ঠিক রেখে সংস্কার করবে। কিন্তু না, ভেঙেই ফেলা হলো। এতবড় একজন কবির স্মৃতি, আমাদের ঐতিহ্য ভেঙে ফেলার আগে কেউ একটিবার ভাবল না। বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংস্কার করতে গেলে আগে তাদের বলা হয় অবকাঠামো ঠিক রাখতে। অবকাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই আপোষ করা হয় না। কিন্তু ধানমন্ডির বাড়িটি নিয়ে এভাবে ভাবা হলো না। সবচেয়ে বড় কথা ওই বাড়ি তো বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন কবিকে। তার কথাও ভাবল না কেউ। সেখানে আমাদের জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ছিলেন। তিনিও কিছু বললেন না। আমিও সেখানে ছিলাম। তারা আমাকেও একটিবার কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলেন না। খুব আশ্চর্য হই এটা ভেবে।

কবিকে নিয়ে আপনার একান্ত কোনো ভাবনা যদি প্রকাশ করতেন।

কবিকে নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা রয়েছে। তাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টরি করতে চাই। কেউ এ রকম করেনি। এরইমধ্যে কথা হয়েছে। জুলাইয়ের দিকে কাজ শুরু হতে পারে। দুই দেশেই শুটিং হবে। আর একটা ভাবনা আছে। এটা আমার একার পক্ষে সম্ভব না। দাদু তো চার হাজারের বেশি গান লিখেছেন। আমার মনে হয় তার নামে একটি মিউজিক বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। সেখানে শুধু তার গান নিয়েই কাজ হবে। এ ছাড়া বিদ্রোহী কবিতার ওপর দুই বাংলার লেখকদের নিয়ে একটি বই করতে চাই আমি।

পশ্চিমবঙ্গেও কবির পরিবারের সদস্যরা আছেন। তাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়?

হ্যাঁ, যোগাযোগ আছে। ওরা তো আমার ভাই-বোন। নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ছোট বোন অনিন্দিতা আমেরিকায় থাকে। আর যে দুই ভাই আছে, তাদের একজন ছবি আঁকে, আরেকজন গিটার বাজায়। যে ছবি আঁকে তার একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানও আছে।

আরআর/আরএসও

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর