শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

গোয়েন্দা গল্পের সিনেমায় পিছিয়ে কেন ঢালিউড

রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ
প্রকাশিত: ০৪ মার্চ ২০২২, ১১:৩৮ এএম

শেয়ার করুন:

গোয়েন্দা গল্পের সিনেমায় পিছিয়ে কেন ঢালিউড
ঢালিউডে গোয়েন্দা সিনেমা না হওয়ার পেছনের কারণ জানালেন সংশ্লিষ্টরা । কোলাজ: ঢাকা মেইল

ম্যাড়ম্যাড়ে প্রেম-ভালোবাসা আর মারদাঙ্গা গল্পের সিনেমা দেখে দর্শকের রুচিতে জং ধরে গেছে! স্বাদ বদলাতে ব্যতিক্রম গল্পের সিনেমার চাহিদা থাকলেও প্রযোজক-পরিচালকরা সে পথ মাড়াচ্ছেন না। দশকের পর দশক ধরে সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে চলেছেন তারা। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের রুচি বদলায়— এই উপলব্ধির জায়গা থেকে হাজারো ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া ভারতীয় বাংলা সিনেমা শক্ত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে যেমন গ্রামের দর্শকের কথা ভেবে বলিউড কিংবা দক্ষিণী ছবির রিমেক করা হয়, তেমন শহুরে মধ্যবিত্ত দর্শক হলে টানতে নবধারার সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। সেইসব সিনেমার বড় অংশজুড়ে আছে গোয়েন্দা-থ্রিলার। রহস্য-রোম্যাঞ্চ গল্পে বুঁদ হয়ে আছেন সেখানকার দর্শক। লগ্নিকৃত টাকা তুলতে খুব একটা বেগও পান না প্রযোজক। 


বিজ্ঞাপন


বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তুখোড় সব গোয়েন্দা চরিত্র দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে এখানকার রুপালি পর্দায় তাদের বিচরণ নেই বললেই চলে। ফলে কল্পনার রাজ্যেই থেকে যাচ্ছেন তারা। 

বইয়ের পাতা থেকে তুলে তাদের পর্দায় উপস্থাপন করা হচ্ছে না কেন— প্রশ্ন ছিল থ্রিলার নির্মাতা সঞ্জয় সমদ্দারের কাছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের দর্শকের মধ্যে গোয়েন্দা সিরিজ নিয়ে উন্মাদনা কম। কলকাতায় ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সী কিংবা কিরীটি রায়সহ অন্যান্য গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে নিয়মিত চর্চা হয়, সেটা আমাদের এখানে হয় না। তাছাড়া আমাদের দেশের বাংলা সাহিত্যে সেভাবে গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি হয়নি। ‘মাসুদ রানা’ ও ‘তিন গোয়েন্দা’ ছাড়া জনপ্রিয় কোনো চরিত্র নেই।’

sanjay somaddar
সুযোগ পেলে দেশি কোনো গোয়েন্দা চরিত্র পর্দায় তুলে আনতে চান সঞ্জয় সমদ্দার । ছবি: ফেসবুক

তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বক্সী এখানকার পাঠক বা দর্শক সেভাবে আপন ভাবেন না। কারণ, চরিত্রগুলো সেখানকার প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দর্শক ‘মাসুদ রানা’ কিংবা ‘তিন গোয়োন্দা’কে পর্দায় দেখতে চান। ইতোমধ্যে তো মাসুদ রানাকে নিয়ে সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই ভালো দিক।’


বিজ্ঞাপন


আপনি গোয়েন্দা নির্ভর সিনেমা বানাতে চান কি না— জানতে চাইলে সঞ্জয় বলেন, ‘পরিচালক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা চরিত্রগুলো টানে না। নির্মাণ করতে চাইলে অবশ্যই আমি দেশি কোনো গোয়েন্দা চরিত্র বেছে নেব। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই, আরও বেশি গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি হোক আমাদের দেশীয় সাহিত্যে।’

তরুণ নির্মাতা ভিকি জাহেদ মনে করেন, গোয়েন্দাধর্মী গল্পের সিনেমা নির্মাণ কঠিন, তাই সচরাচর কেউ এ ধরনের সিনেমা বানানোর ঝুঁকি নেন না।

ভিকি বলেন, ‘ডিটেকটিভ থ্রিলার নির্মাণ বেশ জটিল। বড় ক্যানভাসে করতে হয়। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা লাগে। এতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। এসব দিক বিবেচনায় পরিচালকরা সাধারণত এই জনরার সিনেমা নির্মাণ করতে চান না।’

Vicky Zahed
ভবিষ্যদে গোয়েন্দ থ্রিলার সিনেমা নির্মিত হবে বলে মনে করেন ভিকি জাহেদ । ছবি: ফেসবুক

তাহলে কি ভালো পরিচালক সংকট আমাদের— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক ভালো মেকার আছেন। গল্প বাছাই থেকে শুরু করে পোস্ট প্রোডাকশন পর্যন্ত যদি ওই পরিশ্রমটা করতে পারি, তাহলে ভালো গোয়েন্দা থ্রিলার সিনেমা বানানো সম্ভব। তবে প্রযোজকদেরও সদিচ্ছা থাকতে হবে। এসব গল্প বোঝা প্রযোজক খুব সীমিত। তবে এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আছে। ভবিষ্যতে হয়ত এ নিয়ে কাজ হবে।’

দেশের সর্বাধিক বাণিজ্যিক ঘরানার চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন আব্দুল্লাহ জহির বাবু। তার মতে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কথা বিবেচনা করে গোয়েন্দা গল্পের সিনেমা নির্মিত হয় না। 

আব্দুল্লাহ জহির বাবু বলেন, ‘একটি খুনের ঘটনা এবং পরে রহস্য উন্মোচন হলো গোয়েন্দা সিনেমার কাহিনি। বাণিজ্যিক ধারার সিনেমার মতো ডিটেকটিভ ছবিতে অ্যাকশন কিংবা গান থাকে না, যা দর্শক টানতে পারে। এ দেশে এই জনরার সিনেমার জনপ্রিয়তা আছে, তবে সিনেমা হলে হলে দর্শক টেনে আনার ক্ষমতা নেই। আর সেকারণে, প্রযোজক লাভের কথা চিন্তা করে এমন সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হন না। আমাদের ঢাকার বাইরের দর্শকের কথা চিন্তা করতে হয়। তারাই সিনেমার মূল দর্শক।’

Abdullah
দেশের সর্বাধিক বাণিজ্যিক ঘরানার চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য আব্দুল্লাহ জহির বাবু । ছবি: সংগৃহীত

কেবল শহুরে মধ্যবিত্ত দর্শকের জন্য গোয়েন্দাধর্মী সিনেমা নির্মিত হতে পারে না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে শহুরে দর্শকের সংখ্যা জানতে হবে। কলকাতায় সিনেপ্লেক্সে মুক্তি দিয়ে এ ধরনের সিনেমার লগ্নিকৃত টাকা উঠিয়ে আনতে পারেন প্রযোজক। আমাদের কিন্তু তেমন সিনেপ্লেক্স নেই। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের দর্শকের চিন্তা মাথায় নিয়েই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখি। ঢাকার দর্শকের কাছে যে সিনেমাটি ভালো লাগবে, সেটি বাইরের ঢাকার বাইরের মানুষের কাছে ভালো লাগবে না। রুচির পার্থক্য আছে। রুচিশীল দর্শকরা সিনেমা হলে যান কম।’

এদিকে গোয়েন্দা সিনেমা নির্মাণ না হওয়ার পেছনে ভালো চিত্রনাট্যের অভাবকে দুষছেন প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে কলকাতার মতো প্রচুর গোয়েন্দাধর্মী সিনেমা দেখার দর্শক আছেন। কিন্তু কেউ সেরকম চিত্রনাট্য আমাদের কাছে নিয়ে আসেন না। অথচ বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র আছেন। আমরাও চাই তাদের পর্দায় আনতে।’

Khosru
ভালো চিত্রনাট্য পেলে গোয়েন্দা নির্ভর সিনেমা প্রযোজনা করবেন খসরু । ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে অনেক ভালো নির্মাতা আছেন। তারা বাজেট পেলে মানসম্মত গোয়েন্দা গল্পের সিনেমা বানাতে পারবেন। আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে তাদেরও সদিচ্ছার অভাব আছে। কোনো পরিচালক যদি গোয়েন্দা গল্পের চিত্রনাট্য নিয়ে আসেন, তাহলে তাকে আমরা ফেরাব না।’

ঢালিউডে গোয়েন্দা গল্পের সিনেমা না হওয়ার কারণ অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলেন হইচই বাংলাদেশের কনটেন্ট লিড সৌভিক দাশগুপ্ত। তার ভাষ্য, ‘কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে দীর্ঘকাল ধরে গোয়েন্দা উপন্যাস লেখার প্রচলন আছে। অনেক আইকনিক গোয়েন্দা চরিত্র আছে— ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা বা প্রদোষ মিত্র, হুকাকাশি, কর্ণেল, মিতিন মাসী। এমনকি ছোটদের জন্য গোগোল বা পান্ডব গোয়েন্দা। পরবর্তীকালেও অনেকে এসেছেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ মিত্র, সমরেশ বসুর মতো সাহিত্যিক আলাদাভাবে গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন, গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করেছেন।’

souvik
বাংলাদেশে গোয়েন্দা সাহিত্য বা চরিত্র তৈরি হয়নি বলে মনে করেন সৌভিক দাশগুপ্ত । ছবি: ফেসবুক

সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট এই এডজান্ট ফ্যাকাল্টি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সেই অর্থে গোয়েন্দা সাহিত্য বা চরিত্র তৈরি হয়নি। ‘তিন গোয়েন্দা’ ছাড়া আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। মিসির আলি সেই অর্থে গোয়েন্দা নন। গোয়েন্দা সাহিত্যকে খুব একটা সিরিয়াস সাহিত্য বলে বোধহয় মনে করা হয়নি। আমার ধারণা বাংলাদেশে গোয়েন্দা সিনেমা-সিরিজ না হওয়ার এটা বড় কারণ।’

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা একটা জায়গায় একমত যে, গোয়েন্দা গল্পের সিনেমার দর্শক পদ্মাপাড়ের এই দেশটিতে আছে। কিন্তু গাটের টাকা খরচ করে সিনেমা হলে গিয়ে দেখার মানসিকতা কম! ড্রয়িংরুম কিংবা হালের জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অল্প খরচে এ ধরনের বিদেশি সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা। তবে সেই সংখ্যা সীমিত। তাই এখানে বইয়ের পাতায়ই সীমাবদ্ধ থাকছে গোয়েন্দা চরিত্র।

আরএসও 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর