মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

শরণার্থী থেকে নায়করাজ রাজ্জাক

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১ আগস্ট ২০২২, ১০:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

শরণার্থী থেকে নায়করাজ রাজ্জাক
‘আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা, আমার সবকিছু অভিনয় আর চলচ্চিত্র। এ ছাড়া আমি আর কিছু জানি না, পারি না। আল্লাহ আমাকে অনেক সুযোগ দিয়েছেন। অনেক কিছু করতে পারতাম। করিনি।’

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়করাজ রাজ্জাক বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের সম্পর্কে বলছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য তিনি কিছু করেছেন কি না— এমন হিসাব কষতে যদি চাই, তাহলে সেটা সফল না হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ, এ দেশের চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের অবদান হিসাব করে বের করার মতো কোনো সমীকরণ নয়। দীর্ঘ ৫০ বছরে তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রকে মুঠোভরে এতটাই দিয়ে গিয়েছেন, যার ঋণ শোধ করার চিন্তা করা ধৃষ্টতার শামিল।


বিজ্ঞাপন


রাজ্জাকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি টালিগঞ্জের নাকতলার ৮ নম্বর বাড়িতে তার জন্ম। তখন কে জানত, জাপানি বোমারু বিমানের আক্রমণের আশঙ্কার মুখে জন্ম নেওয়া ছেলেটি হবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রবাদপ্রতিম পুরুষ! এটা হয়তো রাজ্জাক নিজেও জানতেন না। আর জানলে হয়তো প্রথম জীবনে ফুটবল খেলাকে আপন করে না নিয়ে চলচ্চিত্রকে আপন করে নিতেন। যদিও ফুটবল খেলার মাঠই তাকে অভিনয় করার পথ দেখিয়েছে। তিনি ছিলেন দক্ষিণ টালিগঞ্জ ফুটবল দলের এক নম্বর গোলকিপার। ভাড়ায় টালিগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যেতেন। এন্ট্রান্স (বর্তমান এসএসসি) পরীক্ষায় আগে তিনি একবার যাদবপুর দলের সঙ্গে খেলার সময় প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তারপর চার/পাঁচ ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফেরে। এরপর অনেকটা রাগ করে ফুটবল খেলা ছেড়ে দেন। কিন্তু ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার আগে ১৯৫২-৫৩ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি খেলার মাঠ থেকে ডেকে মঞ্চনাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। তবে প্রথমে রাজি হননি। পরে শিক্ষকের কথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নাটকে অভিনয় করেন। সেই থেকে শুরু।

Razzak

এরপর রাজ্জাক বিদ্যালয়ের বাইরে মঞ্চনাটকে অভিনয় করতে আরম্ভ করেন। একবার তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে গিয়ে একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ছয় মাস থাকেন। সেখান থেকে ফেরার পর নায়ক হওয়ার চিন্তা তাকে পেয়ে বসে। কলকাতায় অনেক চেষ্টা করে তিনি কোনোমতেই সুযোগ পাচ্ছিলেন না নিজের প্রতিভা প্রমাণ করতে। সবাই তাকে আশা দিলেও কাজে না নেওয়ায় ভেঙে পড়েন। কিছু চলচ্চিত্রে এক্সট্রা শিল্পীর কাজ করলেও তার মন ভরেনি। এ অবস্থায় পীযূষ সাহা নামের একজন তাকে বাংলাদেশে চলে আসার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশে চলে আসেন। তখন আবার ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল। মুসলিমরা অনেকে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসতে লাগল। রাজ্জাকের বাংলাদেশে আসার পেছনে এটাই বড় কারণ।

বিবিসি বাংলার আরও এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এই শহরে আমি রিফিউজি হয়ে এসেছিলাম। স্ট্রাগল করেছি। না খেয়ে থেকেছি।’


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা রাজ্জাক পরবর্তীকালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অংশ হলেন কীভাবে? এমন প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাজ্জাক জীবনে স্ট্রাগল বা সংগ্রামের কথা বলেছেন। সেটাই তার জীবনে সুফল এনে দিয়েছে। আরও একটু বিস্তারিত আলোকপাত করা যাক।

Razzak

বন্ধু বদরুদ্দিনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে রাজ্জাক ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় পা রাখেন। সঙ্গে স্ত্রী খায়রুন নাহার লক্ষ্মী আর কোলে বাপ্পারাজ। শুরু তার নতুন এক জীবন। যে জীবনে দুবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য তাকে কাজ খুজতে হয় পথে পথে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাকের শুরুটা হয়েছিল সহকারী পরিচালক হিসেবে। পরিচালনা থেকে তাকে বেশি টানত অভিনয়। একবার আনিস নামের অন্য এক সহকারী পরিচালক পরিচালনায় সহকারী করা ছেড়ে অভিনয় করার কথা বলেন। তিনি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। ঢাকায়ও তিনি কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট ছবিতে অভিনয় করা আরম্ভ করলেন। পাশপাশি মঞ্চনাটকে যোগ দিলেন। নাট্যকার আবদুল সাত্তারের নির্দেশিত ‘পাত্রী হরণ’ নাটকের মাধ্যমে ঢাকায় তিনি প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। মাঝেমধ্যে এখানে-ওখানে অভিনয়ের জন্য অডিশন দিতে যেতেন। ছোট ছোট টেলিভিশন নাটিকাতেও অভিনয় করার সুযোগ পান।

পর পর দুটি ছবিতে সহকারী পরিচালনা করার পর কাজ ছেড়ে জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা করেন। জহির রায়হান তাকে ভালোভাবে পরখ করে নিজের লেখা ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য নির্বাচিত করেন। পরে কোনো এক কারণে ছবিটি হয়নি। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবি দিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সফল হন। ছবিটি ব্যবসায়িক সফলতা পাওয়ায় তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রীতিমতো রিফিউজি থেকে নায়ক বনে গেলেন তিনি। একে একে ‘নিশি হলো ভোর’, ‘বাঁশরী’, ‘ময়নামতি’, ‘মনের মত বউ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘আলোর মিছিল’সহ বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করে নিজের জাত চেনান।

Razzak

ক্রমান্বয়ে তিনি নির্মাতা-প্রযোজকদের ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠেন। এসব ছবি বর্তমানে এসে কালজয়ী ছবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজ্জাক স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে কিছু উর্দু ছবিতেও অভিনয় করেন, ‘আখেরী স্টেশন’ (১৯৬৪), ‘উজালা’ (১৯৬৪), ‘গৌরি’ (১৯৯৮), ‘মেহেরবান’ (১৯৬৯), ‘পায়েল’ (১৯৭০) অন্যতম। এর মধ্যে ‘উজালা’ ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালকের কাজ করেন।

এদিকে যখন রাজ্জাক সফলতার সঙ্গে অভিনয় করছেন, তখন হঠাৎ করে এক দুর্ঘটনায় পা হারান সেসময়ের আরেক জনপ্রিয় নায়ক রহমান। চলচ্চিত্রশিল্প তখন রাজ্জাকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বলতে গেলে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি একাই টেনে গেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রকে।

চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে মিষ্টি মেয়েখ্যাত নায়িকা কবরীর সঙ্গে তার জুটি গড়ে ওঠে, যা দর্শক ভালোভাবেই গ্রহণ করেন। এই জুটির অধিকাংশ ছবি ছিল ব্যবসাসফল। একটা পর্যায়ে কবরীর সঙ্গে সামান্য বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তারপর এই জুটি বড় পর্দায় অনিয়মিত হয়ে যায়। কবরী ছাড়াও রাজ্জাক শবনম, শাবানা, ববিতাসহ অনেকের বিপরীতে অভিনয় করেন।

Razzak inner

যে রাজ্জাক চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেই তিনি পরে কলকাতায় অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাই বলে তিনি নিজের মাতৃভূমি কলকাতায় ফিরে যাননি। পরম যত্নে বাংলাদেশকে ভালোবেসে থেকে গিয়েছেন লাল-সবুজ পতাকার তলে।

নিজের অভিনয়গুণে রাজ্জাক ‘নায়করাজ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। আহমদ জামান চৌধুরী তাকে এই উপাধি দিয়েছিলেন। রাজ্জাক সর্বমোট পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সিনেমাগুলো হলো— ‘কী যে করি’ (১৯৭৬), ‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮), ‘বড় ভাল লোক ছিল’ (১৯৮২), ‘চন্দ্রনাথ’ (১৯৮৪) ও ‘যোগাযোগ’ (১৯৮৮) । এ ছাড়া তিনি ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পান।

Razzak Poster

রাজ্জাক প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন। তার প্রথম প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবিটির নাম ‘অনন্ত প্রেম’। তারপর ‘মৌ চোর’, ‘বদনাম’, ‘অভিযান’, ‘সৎ ভাই’, ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘বাবা কেন চাকর’ ইত্যাদি ছবি নির্মাণ করেন।

বাংলা-উর্দু মিলিয়ে প্রায় চার শ’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করা বহু গুণে গুণান্বিত এই নায়ক ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে পাড়ি জমান না-ফেরার দেশে। তার এভাবে চলে যাওয়ায় থমকে গিয়েছে পুরো চলচ্চিত্রশিল্প। সেই সঙ্গে বেদনার নীল আস্তরণ জমা পড়েছে অসংখ্য ভক্তের মনে। প্রিয় নায়ককে আর কখনও দেখা যাবে না নীল আকাশের নিচে হাঁটতে। তবে যতদিন বাংলাদেশের বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে, ততদিন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তারার মতো দেদীপ্যমান থাকবেন কিংবদন্তি নায়করাজ রাজ্জাক।

আরএসও

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর