গেল বছর ব্যর্থতা দিয়ে শুরু হয়েছিল ঢালিউডের। হতাশায় হয়েছে শেষ। এবারও শুরুতে সিন্দাবাদের ভূতের মতো কাঁধে চেপে বসে ব্যর্থতা। মাঝে দুই ঈদ সফল ওঝার ভূমিকা পালন করলেও বাকি সময় শ্বাসকষ্টেই কেটেছে।
ব্যক্তিগত ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর আমদানিকৃত একটিসহ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ৪৭ ছবি।
বিজ্ঞাপন
ব্যর্থতা যেন সিন্দাবাদের ভূত
জানুয়ারিতে ‘মধ্যবিত্ত’, ‘মেকআপ’, ‘কিশোর গ্যাং’, ‘রিকশা গার্ল’ সিনেমাগুলো মুক্তি পায়। সে সময় চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস হতাশা মাখা কণ্ঠে ঢাকা মেইলকে জানিয়েছিলেন প্রথম মাসে লাভের গুড় তো দূরের কথা বিদ্যুৎ বিলও ওঠেনি ছবিগুলো থেকে। ‘মধ্যবিত্তে’র আয় ছিল নিম্নবিত্তের মতো। জৌলুস ছড়ায়নি ‘মেকাপ’। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাজিমাত করলেও সিনেমা হলে অনটনে দিন কেটেছে ‘রিকশা গার্লে’র। ‘কিশোর গ্যাং’ যত না সিনেমা তার চেয়ে বেশি জঞ্জাল বলে বিবেচিত হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে লোকসানের আগুন অঙ্গে অঙ্গে জ্বলেছে ঢালিউডের। এ মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জ্বলে জ্বলে তারা’ হলে জ্বলে ওঠেনি। ‘ময়না’ সফলতার কথা কয়নি, শুনিয়েছে নিখাদ ব্যর্থতার গান। ‘দায়মুক্তি’ও ব্যর্থতার দায় থেকে মুক্তি পায়নি। বিদেশে পুরস্কার ও প্রশংসা মিললেও দেশের সিনেমা হলে দর্শক মেলেনি ‘বলী’র ভাগ্যে।
বিজ্ঞাপন
দুই ঈদে প্রত্যাশিত ফল ঢোকে আশার ব্যাংকে
ঈদ কেন্দ্রিক ঢালিউডে অন্যসময় লাভের আশা আর মরা গাছে জল ঢালা যেন একই কথা। তাই পুঁজি তুলতে রোজার ঈদে জমে সিনেমা মুক্তির হিড়িক। এ ঈদে হাফ ডজন সিনেমা মুক্তি পায়। অন্য বছরগুলোতে সাফল্যের বল একা শাকিব খানের কোর্টে থাকলেও এবারের চিত্র ভিন্ন ছিল। নিশো-সিয়ামের হাতেও ধরা দেয় সফলতা। ‘জংলি’ দিয়ে ক্যারিয়ারের নড়বড়ে ভিত মজবুত করেন সিয়াম আহমেদ। এ ছবির কল্যাণে সাফল্যের ছাতার নিচে আরও এক হন শবনম বুবলী ও প্রার্থনা ফারদিন দীঘি। দর্শকের সকল প্রশংসা নিজের দিকে টেনে নেয় শিশুশিল্পী নৈঋতা হাসিন রৌদ্রময়ী। ‘দাগি’র গল্প দাগ কাটে দর্শকের মনে। সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন আফরান নিশো ও তমা মির্জা। অল্প সময়ের জন্য উপস্থিত হয়ে মুগ্ধতার গল্প লেখেন সুনেরাহ বিনতে কামাল। দর্শক ‘চক্করে’র চক্করে পড়েন। প্রশংসার ঝুলি ভরলেও ব্যবসায়িকভাবে পুঁজি তুলতে পারেনি ছবিটি। মুক্তির আগে ‘কন্যা’ গান দিয়ে উৎসবের আমেজ আনলেও মুক্তির পর মুখ থুবড়ে পড়ে ‘জ্বীন থ্রি’। সফলতা ও ব্যর্থতা দুইয়ের-ই স্বাদ পান শাকিব। তার ‘বরবাদ’ বাংলা সিনেমার ধারণা পাল্টে দেয়। এত বড় ফ্রেমে এর আগে কোনো সিনেমা দেখেনি ঢালিউড। নজরকাড়া লুকের সঙ্গে মানানসই অভিনয় দিয়ে নিজের ও অন্যদের মাঝে ব্যরিকেড তুলে দেন শাকিব। সেইসঙ্গে তৃতীয়বার ইন্ডাস্ট্রি হিট হয় তার ছবি। ‘অন্তরাত্মা’ কিং খানকে দেয় ব্যর্থতার নিখাদ স্বাদ। যদিও বেশ কয়েক বছর ঝুলে থাকা ছবিটির প্রচারণায় ছিলেন না শাকিব।
কোরবানি ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছয়টি ছবি-ই আলোচিত ছিল। ‘তাণ্ডবে’র তামাটে লুক দিয়ে শাকিব বুক ভরিয়েছিলেন ভক্তদের। জয়া আহসান ও সাবিলা নূরের যোগ বিশেষ করে তুলেছিল ছবিটিকে। তবে টাটকা অবস্থায় পাইরেসির কবলে পড়ায় প্রত্যাশানুযায়ী তাণ্ডব চালাতে পারেনি। যদিও পাইরেসিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লাভের মুখ দেখেছে বলে জানায় প্রযোজনা সংস্থা। ট্রেলারের মতোই হলে চমকে দেয় ‘উৎসব’। নব্বই দশকের গল্প, একঝাঁক তারকাশিল্পীর অভিনয় আর নির্মাণ দিয়ে চুম্বকের মতো দর্শক টানে। অনেক দিন পর হলমুখী হয় মধ্যবিত্ত পরিবার। ফলস্বরুপ বাজেট অনুযায়ী তুমুল ব্যবসা করে তানিম নূরের ছবিটি। শরিফুল রাজের বাণিজ্যিক সিনেমায় ফেরা এবং তাসনিয়া ফারিণ নাম লেখানোয় ‘ইনসাফ’ ছিল মুখে মুখে। তাদের অভিনয় প্রশংসিত হলেও লগ্নি তুলতে ব্যর্থ হয় ছবিটি। শুভর কারণে ‘নীলচক্র’, আজমেরী হক বাঁধনের কারণে ‘এশা মার্ডার: কর্মফলে’র প্রতি মনোযোগ ছিল দর্শকের। সময়পোযোগী টপিক হওয়ায় প্রশংসা পেলেও লাভের মুখ দেখেনি ‘নীলচক্র’। একই অবস্থা ‘এশা’র। গল্প নির্মাণ অভিনয়ে সেরা এ ছবিটি মানের দিক থেকে ভালো হলে আয়ের দিক থেকে শেষ পর্যন্ত ধরতে পারেনি লাভের আঙুল। গানে পূজা চেরি খ্যামটা নেচে মন ভরালেও মুক্তির পর ‘টগর’ পরিণত হয় ডিজাস্টারে।
দুই ঈদের মাঝে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা মোটে দুই। ‘জয়া আর শারমিন’ও ‘আন্তঃনগর’। মোটেও ব্যবসা করতে পারেনি।
বিরতিহীন শ্বাসকষ্ট
কোরবানি ঈদের পর আর মাথাচাড়া দিতে পারেনি ঢালিউড। বছরের শেষ পর্যন্ত কেটেছে শ্বাসকষ্টে। কোনো সিনেমা-ই হয়ে উঠতে পারেনি ইনহেলার। ওই জায়গা থেকে সালতামামির গল্পে এখানেই দাড়ি টানা যায়। তবে বিস্তারিত বলতে গেলে, জুলাইয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্যদিন’, ‘আলী’ কোমর সোজা করতে পারেনি। আগস্টেও হলগুলো ছিল শ্মশানের মতো সুনসান। উড়তে পারেনি ‘উড়াল’। ‘জলরঙে’ আকৃষ্ট হয়নি কেউ।
সেপ্টেম্বরে দুই হালি ছবি মুক্তি পেলেও হাল ধরতে পারেনি কোনোটা। ‘সাবা’ দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ ভরাতে পারেননি মেহজাবীন চৌধুরী। যৌথ প্রযোজনার ‘ফেরেশতে’ ইরানের জাতীয় পুরস্কার জিতলেও দর্শকের মন জিততে পারেনি। বাংলাদেশ থেকে অস্কারের জন্য মনোনীত হলেও ‘বাড়ির নাম শাহানা’বাড়ি (সিনেমা হল) ভর্তি করতে পারেনি দর্শক দিয়ে। ‘উদীয়মান সূর্য’ আলো ছড়ায়নি। ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ দেখতে আসেনি কেউ। ‘আমার শেষ কথা’ কেউ শোনেনি (দেখেনি)। ‘ডট’ ও ‘নন্দিনী’ সিনেমার কপালও অন্যগুলোর মতো ছিল।
অক্টোবরের ছবির সংখ্যা মোটাতাজা হলেও ফলাফল রুগ্ন। আগ্রহ ছিল না হল মালিকদের। প্রচারণায়ও ছিল দারিদ্রের ছাপ। ফলে কোন ছবি এলো গেল দর্শকের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি সে খবর। দর্শক খরায় বেশ কয়েকটি ছবির শো-ই চালাতে পারেনি হল কর্তৃপক্ষ। ছবিগুলো মন্তব্যের অনুপযুক্ত। তবুও বলি, গল্পের ‘সাত ভাই চম্পা’র অগণতি শ্রোতা থাকলেও সিনেমার ‘সাত ভাই চম্পা’র দর্শক খুঁজে পাওয়া যায়নি। ‘অন্ধকারে আলো’য় আলোকিত হয়নি হল। ‘বেহুলা দরদী’কে দরদ দেখায়নি কেউ। ‘ডাইরেক্ট অ্যাটাক’, ‘কন্যা’র কপালেও ছিল একই দুর্দশা।
গেল নভেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর কোনোটাই হাসি ফোটাতে পারেনি হল মালিকদের মুখে। তবে ‘শাটিকাপ’ ওয়েব সিরিজ দিয়ে সকল প্রশংসা নিজের দিকে টানা তাওকীর ইসলামের প্রথম সিনেমা ‘দেলুপি’র গল্প, মেকিঙয়ের প্রশংসা করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ভালো কথায় ঝুড়ি ভরলেও ব্যবসা করতে পারেনি ছবিটি। ‘সাইলেন্স: আ মিউজিক্যাল জার্নি’ জনপ্রিয় সুরকার সংগীত পরিচালক ইমন সাহার শখের ছবি। তবে মিউজিক দিয়ে শ্রোতাদের বুঁদ করলেও নির্মাণ দিয়ে দর্শকদের হল পর্যন্ত আনতে পারেননি। এক দশক আগের ঝুলে থাকা ‘মন যে বোঝে না’ কেউ দেখতে যায়নি। ‘গোয়ার’ মন্তব্যের অনুপযুক্ত।
ডিসেম্বরে শাকিব খানের আশায় ছিলেন হল মালিকরা। ‘সোলজারে’র মুক্তি পিছিয়ে যাওয়ায় নতুন কোনো গল্প রচিত হয়নি মাসটিতে। ‘খিলাড়ী’ নামের একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে যা নিয়ে লেখার মতো কোনো খবর নেই।
আমদানি
গেল কয়েক বছর কয়েকটি করে বলিউড ছবি আমদানি হলেও ২০২৫ সালে একটিও হয়নি। আমদানিকৃত ছবির তালিকায় রয়েছে নেপালি একটি সিনেমা। ‘মিসিং’ নামের সে ছবির প্রতি আগ্রহ দেখাননি দর্শক।
সেরার ঘরে যেসব ছবি
ঢালিউডে বক্স অফিস না থাকায় ব্যবসার সঠিক তথ্য জানা দুষ্কর। তাই পথের সাথী ধোঁয়াশা। তারপরও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ঢাকা মেইলের পর্যালোচনায় বছরের সেরা ছবি ‘বরবাদ’। এ তালিকায় আরও আছে ‘তাণ্ডব, ‘উৎসব’, ‘দাগি’ ও ‘জংলি’।
প্রদর্শক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি আওলাদ হোসেন উজ্জল বলেন, ‘২০২৫ সালের দুই ঈদ থেকে কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবি এসেছে। এর বাইরে একটিও ব্যবসা করতে পারেনি।’
সহ-সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, ‘‘এ বছর যে ছবিগুলো মুক্তি পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে ব্যবসা যাকে বলে সেটি করেছে ‘বরবাদ’। স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করেছে। এরপর ‘তাণ্ডব’, ‘উৎসব’ ভালো ব্যবসা করেছে। ‘জংলি’, ‘দাগি’ও ভালো গেছে অনেকে বলেন। তবে আশাতীত ব্যবসা করেনি। কোনো জায়গায় মোটামটি চলেছে, কোথাও কোথাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।’’
প্রশংসায় ঝুলি ভরেছে যে ছবিগুলোর
বরাবরের মতো এবারও এমন কিছু ছবি মুক্তি পেয়েছে যেগুলো বাণিজ্যিকভাবে সুবিধা করতে না পারলেও মুগ্ধতার সুবাস ছড়িয়েছে সিনেমা হলে। গল্প, নির্মাণ দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে দর্শক ও বোদ্ধাদের। এ তালিকায় রয়েছে ‘চক্কর’ও ‘এশা মার্ডার’ ।
আরআর

