মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কান-ভেনিসের কাতারেই এখন জেদ্দার রেড সি চলচ্চিত্র উৎসব

আলমগীর কবির
প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:১৯ এএম

শেয়ার করুন:

কানে-ভেনিসের কাতারেই এখন জেদ্দার রেড সি চলচ্চিত্র উৎসব

জমকালো লালগালিচা, হলিউড–আরব–এশীয় তারকা আর বিশ্বের নানা প্রান্তের সিনেমা; এসবের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক জেদ্দায় শুরু হয়েছে পঞ্চম রেড সি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল। ইউনেস্কো স্বীকৃত পুরোনো জেদ্দা শহরকে ঘিরে আয়োজিত এ উৎসব চলবে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। থাকছে প্রায় ৭০ দেশের ১০০–এর বেশি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী।

অল্প ক’টি আসরেই উৎসবটি নিজেকে কানের, ভেনিসের মতো বৈশ্বিক চলচ্চিত্র ক্যালেন্ডারের গুরুত্বপূর্ণ এক আসর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আগের বছরগুলোতে এখানে অতিথি হয়ে এসেছেন জনি ডেপ, মিশেল ইয়ো, এমিলি ব্লান্ট, উইল স্মিথ, শ্যারন স্টোনের মতো তারকারা।


বিজ্ঞাপন


নতুন সিইও, নতুন গতি
এবারই প্রথমবারের মতো উৎসবটি পরিচালিত হচ্ছে নতুন প্রধান নির্বাহী ফয়সাল বালতিউরের নেতৃত্বে। তিনি সৌদি চলচ্চিত্রের ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণের অন্যতম স্থপতি হিসেবে পরিচিত। অল্প সময়েই, তার ভাষায়, ‘রেড সি ফিল্ম ফাউন্ডেশন বিশ্ব উৎসব মানচিত্রে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছে, আমরা সেই সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়ে আরও এগিয়ে যেতে চাই।’

বালতিউর জানিয়েছেন, ভিশন ২০৩০–এর লক্ষ্য অনুযায়ী সৃজনশীল শিল্পকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে রেখে দেশের ভেতর ও বাইরে, দুই পরিসরেই সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে তোলাই তাদের উদ্দেশ্য।

আরব–এশিয়া–আফ্রিকার গল্প, সঙ্গে ইউরোপ–আমেরিকাও
২০২৫ সংস্করণে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার নতুন সিনেমা যেমন থাকবে, তেমনি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু আলোচিত চলচ্চিত্রও দেখা যাবে।

উদ্বোধনী ছবি হিসেবে দেখানো হয়েছে ‘জায়ান্ট’। এটি ব্রিটিশ–ইয়েমেনি বক্সিং লেজেন্ড প্রিন্স নাসিম ‘নাজ’ হামেদ–এর জীবনভিত্তিক ছবি। নির্মাণ করেছেন রোয়ান আথলে, অভিনয়ে আছেন আমির এল–মাসরি ও পিয়ার্স ব্রসনান।


বিজ্ঞাপন


মূল প্রতিযোগিতা পর্বে রয়েছে ১৬টি চলচ্চিত্র। আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামের পরিচালক ফিনুলা হ্যালিগান জানিয়েছেন, এ বছরের মূল থিম: ‘হারিয়ে যাওয়া ও নিজেকে খুঁজে পাওয়া’।

এই থিমই ভিন্নভাবে ধরা পড়েছে—

  • বারনি–তে: সোমালিয়ার এক গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে নিখোঁজ হওয়া ৯ বছর বয়সী এক কন্যা শিশুর গল্প (পরিচালক মোহাম্মদ শেখ)।
  • লস্ট ল্যান্ড–এ: প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা ভাষায় নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র (পরিচালক আকিও ফুজিমোতো)।

আরব প্রোগ্রামের পরিচালক অঁতোয়ান খালিফে বলছেন, এ লাইনআপ “সহনশীলতা, অভিবাসন, পরিচয় এবং রূপান্তরের গল্পগুলো দিয়ে সমষ্টিগত বয়ানকে নতুনভাবে সাজাচ্ছে।”

aissa
 উৎসবের উদ্বোধনী আয়োজনে বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন একটি অসাধারণ কালো ব্লেজারের ওপর সাদা ‘ফিশটেল গাউন’ পরে এসেছিলেন। যা আধুনিকতার ছোঁয়াযুক্ত ক্লাসিক গ্ল্যামারের এক নিখুঁত মিশ্রণ।

সৌদি, কোরিয়ান, চীনা নতুন ঢেউয়ের সিনেমা
প্রতিযোগিতা পর্বেই থাকছে সৌদি আরবের অস্কার মনোনীত ছবি হিজরা (পরিচালক শাহাদ আমিন), যেখানে নানী ও তার নাতনিরা হজে মক্কা গমন করেন এক আধ্যাত্মিক যাত্রায়।

আরেক শক্তিশালী ছবি ‘সিঙ্ক’–এ মাতৃত্ব ও মানসিক স্বাস্থ্যের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন তুলে ধরেছেন পরিচালক জাইন দূরাই।

গত কয়েক বছরে বিশ্ব সিনেমা ও টিভিতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপুল উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। এ প্রেক্ষাপটে এ বছর প্রথমবারের মতো রেড সি উৎসবে প্রতিযোগিতায় এসেছে কোরিয়ান ছবি দ্য ওয়ার্ল্ড অব লাভ (ইউন গা–ইউন)।

এর সঙ্গে আছে চীন, তাজিকিস্তান, কেনিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র যার মধ্যে সাতটি সরাসরি রেড সি ফিল্ম ফাউন্ডেশনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পেয়েছে।

শুধু লালগালিচা নয়, সংগ্রামী দেশগুলোর সিনেমার মঞ্চ
সানড্যান্স উৎসব যেমন স্বাধীন ও প্রান্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জায়গা করে দিয়েছে, তেমনি রেড সি–ও শুধু গ্ল্যামার নয়, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেই সব দেশের নির্মাতাদের, যেখানে বহু বছর ধরে চলচ্চিত্র চর্চা ছিল উপেক্ষিত বা বাধাগ্রস্ত।

এর ভেতরেই আছে সৌদি আরব নিজেও। যেখানে কয়েক দশক ধরে জনসাধারণের জন্য সিনেমা হলই ছিল না। ২০১৮ সালে সেসব নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার পর থেকে এক ঝাঁক নতুন নির্মাতা–অভিনেতা উঠে এসেছে; আন্তর্জাতিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গেও শুরু হয়েছে উল্লেখযোগ্য সব যৌথ প্রযোজনা।

অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, জুড ল, পুতিনের চরিত্র আর গাজা
উৎসবে কিছু আলোচিত তারকামুখও দেখা যাবে বড় পর্দায়।

  • অ্যালিস ভিনোকুরের কুতুর–এর মাধ্যমে আবারও অভিনয়ে ফিরছেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
  • অলিভিয়ে আসায়াসের দ্য উইজার্ড অব দ্য ক্রেমলিন–এ এক অপ্রত্যাশিত ভূমিকায় দেখা যাবে জুড ল–কে—তিনি সেখানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

বিশ্ব রাজনীতি ও মানবিক বিপর্যয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়নি এ বছরের প্রোগ্রাম। কাওতার বেন হানিয়ার দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজাব—ডকু–ড্রামা ঘরানার এক তীব্র ও মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র—ছয় বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি মেয়ের কাহিনি ঘিরে নির্মিত।

বালতিউর জানালেন, এ বিশেষ প্রদর্শনীগুলোই উৎসবের প্রকৃত চেতনাকে ধারণ করছে ‘শিল্পের সীমানা পেরিয়ে গভীরভাবে মানবিক গল্পগুলোর জন্য জায়গা তৈরি করা।’

ফুটবলের দেশেও ‘সাইপান’ নিয়ে কৌতূহল
ফুটবল–পাগল সৌদিতে বেশ কৌতূহল জাগিয়েছে সাইপান নামের এক ছবি আয়ারল্যান্ডের কোচ মিক ম্যাকার্থি আর তার অধিনায়ক রয় কিন–এর ২০০২ বিশ্বকাপের আগে হওয়া বহুল আলোচিত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে নির্মিত এ চলচ্চিত্র।

প্যানেল, তারকা আর ‘ইন কনভারসেশন’
উৎসবের বিভিন্ন প্যানেল আলোচনা ও মাস্টারক্লাসে অংশ নেবেন খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতারা। এ বছর থাকছেন—

  • উদ্বোধনী ছবির নায়ক আমির এল–মাসরি
  • দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজাব–এর পরিচালক কাওতার বেন হানিয়া
  • মিশরীয় তারকা লাবলেবা
  • সৌদি অভিনেতা ইয়াকুব আলফারহান

এর আগে এ ‘ইন কনভারসেশন’ সেশনে অতিথি হয়েছেন পরিচালক স্পাইক লি, অভিনেত্রী ইভা লংগোরিয়া ও গুইনেথ প্যালট্রোর মতো তারকারা।

ভিশন ২০৩০ আর নারী–নেতৃত্বের অঙ্গীকার
পঞ্চম বছরে পা দেওয়া রেড সি উৎসব এখন সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ—যার লক্ষ্য অর্থনীতি বহুমুখীকরণ ও জেদ্দাকে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।

আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামের পরিচালক ফিনুলা হ্যালিগান বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেছেন, উৎসবের পরিচালনা ও কর্মপরিসরে নারীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

ee-1
অভিনেত্রী ফে পেরায়া রেড কার্পেটে ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন, যেখানে তারকারা স্বাচ্ছন্দ্যে মিশে যাচ্ছিলেন। ফ্ল্যাশ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছিলেন, যা প্রমাণ করে যে রেড কার্পেট একাধারে জমকালো এবং আরামদায়ক হতে পারে।

‘ফেস্টিভ্যাল ফেভারিটস’–এর টিকিটেই বেশি ভিড়
এ বছরও সবচেয়ে বেশি চাহিদা ‘ফেস্টিভ্যাল ফেভারিটস’–এর টিকিটে—সারা বছরের আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত ১২টি ছবি দেখানো হবে এই বিশেষ বিভাগে।

ফয়সাল বালতিউর বলেন, ‘ফেস্টিভ্যাল ফেভারিটস’ আসলে এক অসাধারণ চলচ্চিত্র বছরের সারাংশ। বড় বড় আন্তর্জাতিক উৎসবে সাড়া জাগানো বারোটি ছবি আমরা বেছে এনেছি। প্রতিটি ছবি ঐতিহাসিক জেদ্দার হৃদয়ে বসে দর্শকদের জন্য বিশ্ব সিনেমার এক অনন্য জানালা খুলে দেবে—যা পূর্ব–পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করবে এবং সৌদি আরবকে চলচ্চিত্রের এক শীর্ষ গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করবে।’

/একেবি/ 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর