সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে আভাস ব্যান্ডের নতুন গান ‘সত্তা’। গানটির সূত্র ধরে আলাপ জমেছিল ব্যান্ডের গায়ক তানযীর তুহীনের সঙ্গে। জনপ্রিয় এ সংগীত শিল্পী বিভিন্ন বিষয়ে ঢাকা মেইলের কাছে খুলেছিলেন মনের আগল।
বিজ্ঞাপন
আভাসের নতুন গান ‘সত্তা’ এসেছে। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
মোটামুটি ভালো সাড়া পাচ্ছি। ভাইরাল পর্যায়ের রেসপন্স আমরা কখনও আশা করি না। এ ধরনের গান ভাইরাল হওয়া কঠিন। সময়ের সঙ্গে শুনতে শুনতে ভালো লাগবে বলে আশা করছি।

ব্যান্ডের শেষ গান ‘ক্যামেরা’ এসেছিল ২০২৩ সালে। নতুন গান প্রকাশে এত দেরি কেন?
বিজ্ঞাপন
ওই সময়টায় দেশে গান প্রকাশ করে আনন্দ করার সুযোগ কম ছিল। আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক পরিবর্তন হলো। অনেক প্রাণ গেল। এরপর উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের প্রাণহানি হলো। আনন্দ করার সময়টা কম ছিল তখন। সবাই শোকের মধ্যে ছিলাম। শোকের মধ্যে কোনো সৃষ্টি আনন্দ দেয় না। তাছাড়া সেসময় কাজও কম হয়েছে আমাদের। এখন সব স্বাভাবিক হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আবার গানবাজনা হবে।
আভাসের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে কতটা সময় লেগেছে?
ছোটবেলার একটি ব্যান্ডের (শিরোনামহীন) সঙ্গে ইনোসেন্ট বয়স থেকে বেড়ে ওঠার যে সম্পর্ক তৈরি হয় সেটা একরকম। অন্যদিকে মধ্যবয়সে এসে পরিণত কয়েকজন মানুষ নিয়ে নতুন একটি ব্যান্ড করা, সেটার সঙ্গে অভ্যস্ত হতে অবশ্যই একটু সময় লাগবে। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের ব্যান্ডের সবাই চমৎকার প্রতিভার এবং সমমনা। গত সাত বছরে আমরা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ড থেকে বেরিয়ে নতুন ব্যান্ড (আভাস) গড়ে তোলা অনিশ্চিত যাত্রা মনে হয়নি?
সুনিশ্চিত-অনিশ্চিত বিষয়টা তখন নির্ভর করবে যখন আপনি একটা প্রত্যাশার ভেতর দিয়ে যাবেন। শিরোনামহীন জন্মের সময়ও আমার কোনো প্রত্যাশা ছিল না। ভালো কিছু গান করব যেগুলো শুনে মানুষ আনন্দ পাবে— এরকম প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়েছি। কিন্তু চাপ কখনও ছিল না। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার দোয়া ও আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। সেই জায়গা থেকে সাধারণ মানুষের ওপর ভরসা করে আমরা চেষ্টা করেছিলাম গান করার।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়েছেন কখনও?
একটা পেশাদার জীবন পার করলে অবশ্যই সবাই প্রাপ্তি-প্রত্যাশা মেলানোর চেষ্টা করে। আমরাও মেলাই। আমাদের জায়গাটা দৈনন্দিন নিত্য অপরিহার্য জিনিসের মতো না। এটা মনের খোরাকের জিনিস। শ্রোতাদের শোনার চর্চা, তাদের পরিণত হয়ে ওঠা, সামাজিক মাধ্যমে সাংবাদিকরা কাদের ভাইরাল করছেন, কোন শিল্পকে এগিয়ে রাখছেন— সবকিছু মিলিয়ে একটা শিল্প। সেখানে প্রাপ্তি-প্রত্যাশার দিকেও খেয়াল রাখি। শ্রোতাদের পরিস্থিতি, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, কীরকম সংস্কৃতি এখন সবাই বেশি গ্রহণ করছে— আমরা দেখি। তবে আমরা নিজস্ব আদর্শ ও দর্শনে চলতে আগ্রহী।

আপনি স্থাপত্য বিদ্যায় পড়েছেন। আপনার গানে এর প্রভাব কতটা?
এটা শতভাগ প্রভাব ফেলে। কারণ আমি যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছি সেটি মূলত মানুষের উন্নতির জন্য। যে দেশের স্থাপত্য যত উন্নত সে দেশ তত উন্নত হবে। তাদের জীবনধারা, আচরণ, ব্যক্তিত্ব সবকিছুই সেভাবে উন্নত হবে। প্রেম-ভালোবাসার গানের জন্য প্রচুর মানুষ আছে। তারা বিভিন্নভাবে প্রেম ভালোবাসার গান করবেন। আমরাও করি। তবে আমরা তার থেকে বেশি চাই সমাজ নিয়ে বলতে। আমাদের অসুবিধা, অপ্রাপ্তি, আটকে থাকাগুলো নিয়ে কথা বলতে আমরা একটু বেশি আগ্রহী। এখনকার এই সময়ের গল্পগুলো ৫০-১০০ বছর পর মানুষ শুনলে জানবে— এই সময় বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে থাকতেন বা আমাদের সুখ-দুঃখ কীসের মধ্যে নিহিত ছিল।
শিরোনামহীনের সবাই স্থাপত্য বিদ্যার ছাত্র ছিলেন। সে কারণে কী গানগুলোর স্বাদ আলাদা?
২০০০ সালে যখন শিরোনামহীনের জন্ম হয় সেসময় চারজন ছিলাম। আমি, ফারহান করিম, ইয়াসির তুষার। পরে জিয়া (জিয়াউর রহমান জিয়া) আসে। আমরা সবসময় চেয়েছি আর্কিটেকচারাল কাজের কথাগুলো যেন শিরোনামহীনের গানে উঠে আসে। যেন একটা সুন্দর ফুটপাত পাই, সেখানে একটা মেয়েকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে, ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে হাঁটতে পারি। আমার মনে হয় শিরোনামহীনের বেসিক মূলত ফারহান ও তুষারের যুগলবন্দী। ফারহানের সারোদ বাজানো এবং তুষারের ফ্লয়ডিকাল গিটার বাজানো। এ দুটোর কম্বিনেশন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল। এটা ওই সময় একদম নতুন ছিল। সবার কাছে একটা বিস্ময়ের জায়গা ছিল। আমার কাছেও তাই। সেই সাউন্ডটা শিরোনামহীনের প্রতি সবার ভালোবাসা জাগিয়েছে। তাছাড়া আমাদের গানের কথাগুলো তো ছিল-ই।

দেশ-বিদেশের কোন শিল্পীরা সবসময় আপনার সঙ্গে থাকেন?
আমাদের দেশের সব শিল্পী থাকেন। বাংলা ভাষাভাষী সব শিল্পীর ভালো গান আছে। এটা কোনো ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর না। দুই জনের নাম অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে— জেমস ভাই, আইয়ুব বাচ্চু ভাই। আমাদের পথিকৃৎ আজম খান। ক্লাসিক্যাল শিল্পীদের মধ্যে আছেন এন্ড্রু কিশোর। তার কণ্ঠের ভক্ত আমি। এছাড়া সুবীর নন্দী, কলিম শরাফী, ফরিদা পারভীন ছিলেন। তাদের সবার সেরা কাজ আছে। যে কাজগুলো দেশের সবাইকে আপ্লুত করে, আমাদেরকেও আপ্লুত করে। বিদেশের ফ্লয়েডকে পছন্দ করি। মার্ক নফলার, জিম মরিসন, বব ডিলান— যারা যুগে যুগে সমাজের কথা বলছেন তাদের গানগুলো আমার পছন্দ।
অনেকে বলেন ব্যান্ড সংগীত জৌলুস হারিয়েছে। আপনারও কী তাই মনে হয়?
ব্যান্ড সংগীত জৌলুস হারায়নি। বাণিজ্যিক চটুল গানগুলোকে বেশি উপস্থাপন করা হচ্ছে। ব্যান্ডের সিনিয়রদের এবং শক্তিশালী ব্যান্ডগুলোর ক্রিয়েশন বা কনটেন্ট করোনার কালে এত কমে গিয়েছিল যে ওই সময় কিছু চটুল বা বাণিজ্যিক কাজ ফেসবুক-ইউটিউবে প্রচুর চলে আসে। অনেক সাংবাদিক সেইসব অপ্রয়োজনীয় সংস্কৃতিকে এত ব্যাপকভাবে প্রমোট করেছেন যা সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। তাছাড়া শিক্ষাগতভাবে আমরা একটু দুর্বল। আমাদের বড় অংশের শিক্ষার অভাব। ফলে তাদের রুচিবোধের সঙ্গে যায় এমন গানগুলো বেশি হওয়ায় শুদ্ধ সংস্কৃতি চাপা পড়ে গেছে। আমার বিশ্বাস আমরা শিগগিরই এখান থেকে বেরিয়ে আসব। নতুন জেনারেশনের ব্যান্ড আসছে। তারাও গান করবে। ভালো শিল্পীদের কথা এবং যে সংস্কৃতি অনেক দিন টিকবে সেসবের কথা প্রচারের দায়িত্ব সাংবাদিকদের পালন করতে হবে।

দেশের সিনেমায় ব্যান্ডের গানের ব্যবহার একেবারেই কম। কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?
ব্যান্ডের গান ইমপ্লিমেন্ট করার মতো বাংলা সিনেমা কম হয়েছে। ব্যান্ডের গান এত দামি যে চাইলেই সস্তা জায়গায় গেঁথে দিতে পারবেন না। মান্না ভাইয়ের (চিত্রনায়ক মান্না) আম্মাজান সিনেমায় বাচ্চু (আইয়ুব বাচ্চু) ভাইয়ের গান আছে। তিনি হয়তো সিনেমার মতো করে বানিয়েছেন। কিন্তু এটাকে ব্যান্ডের বলা চলে না। ওনার সলো প্রজেক্ট হতে পারে। ব্যান্ডের গান কোন পাত্রে কোন স্থানে রাখবেন সেই জায়গার ডেসক্রিপশন লাগবে।
বাণিজ্যিকভাবে গান ব্যবহারের মাধ্যম বেড়েছে। তবুও সংগীতে দৈন্যদশা কেন?
আমাদের বাণিজ্যিক গানের শ্রোতা বেশি। যার ফলে ডিস্ট্রিবিউটররা ওইরকম গান নিয়েই কাজ করেন। একটি শহরের মানুষ যদি আম খেতে চায় তাদের আম-ই খাওয়াবে। কেউ যদি স্ট্রবেরি বা জাম খেতে না চায় জোর করে তো তাকে খাওয়াবে না। কারণ ব্যবসায় কেউ লোকসান করতে চায় না। আমাদের শ্রোতার সংকট হচ্ছে। গান শুনে একদিন পরেই লিখে দেন নাইস, ভালো হয়েছে, পরের গান কবে আসবে— সেই শ্রোতাকে আমি কম কাউন্ট করতে চাই। ব্যান্ডের একটি গান বানাতে সময়, অধ্যবসায় খরচ হয়। অন্যদিকে একটি কমার্শিয়াল গান হয়তো এক ঘণ্টায় বানিয়ে ফেলতে পারবে। চটুল কথা বলে, একটু ড্রাম বাজিয়ে বিনোদন দিতে পারে। কিন্তু সেগুলো স্থায়িত্ব পায় না। আমরা চাই সেই গান আসুক যে গান ৫০-১০০ বছর ধরে মানুষের মনে থাকবে এবং শালীনতার মধ্যে আমাদের বাংলা ভাষাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবে।

শ্রোতাদের রুচিবোধ তৈরিতে শিল্পীদের দায় কতটা?
শিল্পীদের দায় একার না। রুচিশীল শিল্পী, শিল্প ব্যাবস্থা, শিক্ষা ব্যাবস্থা,শক্তিশালী শ্রোতা, ডিস্ট্রিবিউটর, শান্ত দেশ— সবকিছুর সমন্বয় দরকার। শিক্ষিত সৎ সাংবাদিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। রুচিবোধ পরিবার ও শিক্ষা ব্যাবস্থার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় মনুষ্যত্বের দায়বদ্ধতা।
সম্প্রতি জেমসের একটি কনসার্টের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। একে অনেকে শিল্প-সংস্কৃতির জন্য অশনি সংকেত মনে করছেন। আপনার কী মনে হয়?
আমি বিস্তারিত জানি না। শুধু শুনেছি কনসার্ট বন্ধ হয়েছে। কিন্তু একটা কনসার্ট বন্ধ হলে হায় হায় শুরু করে দিলাম— আমাদের এত অস্থির হলে হবে না।

এ দেশে শিল্পীর কদর নেই— বিভিন্ন ঘটনায় ত্যক্ত হয়ে অনেকে অনেক সময় বলেন। আসলেই কী তাই?
আমরা তো সবাই কদর পাই। জেমস ভাইয়ের কনসার্ট হলে মানুষ ভেঙেচুরে চলে আসে। কদর অবশ্যই আছে। ২০ কোটির মধ্যে সামান্য কিছু মানুষ হয়তো ভাষার ব্যবহার জানে না, এসব ব্যাপারে অবগত না বা তাদের চরিত্র-ই হচ্ছে কিছু বলতে হবে। এগুলোকে গায়ে মাখা যাবে না। তবে ২০ কোটির মধ্যে ১৯ কোটি যদি এরকম করে তখন বিপদের সম্ভাবনা থাকে। যদি ১০ কোটি বা ১৫ কোটি এরকম করে তাহলে কাহিনি আছে। বিশ কোটি লোকের মধ্যে হয়তো পাঁচ হাজার লোকও এরকম করে না।
মা ছাড়া জীবন কেমন?
মাকে ছাড়া জীবনটা শূন্য। জন্ম থেকে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ হচ্ছে মা। ওই অ্যাকাউন্টটা ক্লোজ হয়ে গেলে অসহায় লাগে। এটা অভ্যাসের ব্যাপার। আমরা ভালোবাসায় অভ্যস্ত। মা আমাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। মায়ের অভাব প্রতি মুহূর্ত প্রকট আকার ধারণ করে। এক গ্লাস পানি খেতে গেলেও মাকে মনে করি। কোথাও তাকালে মনে হয় এখানে মা হাঁটত, বসত। চুলে হাত দিলে মনে হয় মা হাতিয়ে দিচ্ছে বা আচড়ে দিচ্ছে।
আরআর

