গানের প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসেন কানিজ খন্দকার মিতু। তা প্রায় এক দশক আগের কথা। এর মধ্যে তাকে সেভাবে গানে পাওয়া যায়নি। তবে কোক স্টুডিও বাংলার ‘সব লোকে কয়’ গানের জন্য আলোচনায় এসেছেন তিনি। ঢাকা মেইলকে শুনিয়েছেন কোক স্টুডির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনের গল্প। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন আড়ালে থাকার কারণ।
আপনার শুরুটা হয়েছিল একটি রিয়েলিটি শো’র মাধ্যমে সেই ২০১১ সালে। কিন্তু এরপর গান নিয়ে তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি। প্রায় এক দশকের বেশি সময় পর ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র মাধ্যমে আলোচনায় আসলেন। প্রত্যাশা করেছিলেন এটা?
আমি যখন রিয়েলিটি শোয়ে বিজয়ী হই তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। সামনে এসএসসি পরীক্ষা ছিল। পড়ার চাপ ছিল। আমার ফ্যামিলিও চাইছিল পড়ালেখা ঠিক রাখতে। এ কারণে পড়াশোনায় মনোযোগী হই। অনার্স পর্যন্ত লেখাপড়ায় বেশি সময় দেওয়ায় গানে আমাকে তেমন পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাই বলে যে একেবারেই ছিলাম না তা নয়। মাঝে মাঝেই শো করতাম।
আমার ইচ্ছা ছিল ভালো কিছু করার। অনার্স শেষ করে আমি আবার গানে ফিরে আসি। আমার কিছু মৌলিক গানের কাজও চলছিল। এ রকম বড় কোনো প্ল্যাটফর্মে গান করার খুব ইচ্ছা ছিল আমার। বন্ধুদেরও বলতাম, ‘ইশ্, এমন জায়গায় যদি গান করার সুযোগ পেতাম!’ কিন্তু সেটা যে কোক স্টুডিও হবে কখনও ভাবিনি। কোক স্টুডিওর নাম তো আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু সেটা যে আমাদের দেশে হবে এমনটা ধারনায় ছিল না। তবে এমন প্ল্যাটফর্মে যে আমি সুযোগ পেয়েছি এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে অর্ণব দা’ আর শাওন ভাইয়ের (গাউসুল আলম শাওন) কথা না বললেই নয়। পরে শুনেছি তারা নাকি আমার কণ্ঠ নিয়ে আগে থেকেই খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। এখানে দেশের অনেক নামিদামি কণ্ঠশিল্পীরাও অডিশন দিয়েছেন। তাদের সবাই চেনেন। তো তাদের রেখে আমার মতো একদমই অচেনা কেউ সুযোগটা পাবে— কখনও কল্পনা করিনি।

এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?
আসলে আপনারা জানেন কী না জানি না, আমি যে গানটাতে কণ্ঠ দিয়েছি এটা নিয়ে শুরু থেকেই সবাই দ্বিধায় ছিলেন। গানটার জন্য ওনারা অন্যরকম একটা কণ্ঠ খুঁজছিলেন। কিন্তু মনমতো পাচ্ছিলেন না। তো একপর্যায়ে অর্ণব দা’ ‘নাসেক নাসেক’ গানের গায়ক অনিমেষ দাদাকেও জানান, তার জানামতে কেউ থাকলে যেন রেফার করেন। অনিমেষ দা’ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই। একদিন ভোরে নামাজ পড়তে উঠেছি, তখন দেখি অনিমেষ দা’ এসএমএস করেছেন। পড়ে দেখি তিনি লালনের একটি গান আমাকে বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গেয়ে ভিডিও করে পাঠাতে বলেছেন। আমি তখনও জানতাম না দাদা কোক স্টুডিওর জন্য গানটা পাঠাতে বলছেন।
আমি পাঠানোর পরে দাদাকে মেসেজে জিজ্ঞেস করেছি, কী কারণে পাঠাতে বলেছেন। কিন্তু তিনি কোনো রিপ্লাই দেননি। পরে সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে ফোন করে জানান, গানটা কোক স্টুডিওর জন্য নিয়েছিলেন। অনিমেষ দা’ বললেন, ‘তোর গান তো সবাই পছন্দ করেছে। তোকে অডিশনের জন্য আগামীকালই ঢাকা আসতে হবে।’
পরদিনই ঢাকায় চলে যাই। আমার কণ্ঠ অদিত ভাই খুব পছন্দ করেন। পরে অর্ণব দা’ এসে আমাকে গানটি প্রচলিত ও অপ্রচলিত দুটি সুরে গাইতে বলেন। আমি দুই সুরেই তখন গানটা গাই। সেদিন শিল্পকলায় আমার একটা শো ছিল। কোক স্টুডিওর অডিশন শেষে সেখানে চলে যাই। রাত ১১টায় আমাকে আবার ফোন করে তখনই যেতে বলা হয়। আমি গেলে ওনারা আবার ভয়েস দিতে বলেন। আমাকে তখন কোক স্টুডিও বাংলার স্টুডিওতে নেওয়া হয়। সেখানে ভয়েস দিয়ে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর আবার আমাকে ফোন করে যেতে বলা হয়। আমি তখন রাস্তা থেকে ফিরে আবার ভয়েস দেই। আমার কণ্ঠ তাদের ভালো লেগে যায়। এই গানটা করতে অর্ণব দা’ খুব কষ্ট করেছেন। অনেকবার তাকে ভয়েস নিতে হয়েছে।
অর্ণবের সংগীত পরিচালনায় গাইলেন। কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমত, অর্ণব-সুনিধি দম্পতি আমার খুব পছন্দের। অর্ণব দা’র গানের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সংগীতে গাইতে পারা আমার জন্য বড় বিষয়। তবে প্রথম পরিচয়ের দিন তিনি তেমন কিছু বলেননি। হাই-হ্যালো বলে একটু হেসেছিলেন। কিন্তু পরে খুব ফ্রি ছিলেন আমার সঙ্গে। মানে, দাদা কম কথা বলেন। সবসময় পজিটিভি মোটিভেট করেছেন। এই যেমন, আমি গাইতে কোথাও ভুল করলে দাদা বলতেন, ‘আরে ব্যাপার না। আমারও তো ভুল হয়।’
আবার ধরুন, আমার কোথাও সুর সরে গেল, দাদা তখন বলতেন, ‘আরে আমার এটা প্রায়ই হয়। চিন্তার কিছু নেই।’ এভাবে সবসময় আমাকে সাহস জোগাতেন। কারণ, ওখানে তো সবাই বড় বড় মানুষ। আমি একদমই নতুন। খুব ভয়ে ছিলাম। দাদা আমার এই ভয় কাটাতে আমাকে খুব সাহস জুগিয়েছেন। তা ছাড়া স্টুডিওর পাশেই দাদার বাসা। তিনি আমাকে তার পরিবারের সবার সঙ্গে এত সুন্দর করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যে, মনে হয়েছিল আমি তাদের পরিবারেরই একজন। অন্যান্য যাদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সবার কাছে আমার খুব সুনাম করেছেন। আমি খুব ভালো ছাত্রী, আমার রেজাল্ট খুব ভালো—এগুলোও বলেছেন।

আপনি সাধারণত ফোক গান করেন। ফোকের প্রতি আগ্রহের জায়গাটা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল?
আমি নিজে থেকে গান শুরু করেছিলাম। পরিবারের সাপোর্ট ছিল না। আমার পরিবার খুবই রক্ষণশীল। তারা চায়নি গান করি। তো সেসময় শুনে শুনে গান শিখতাম। আর আমি তো যমুনার পাড়ের মেয়ে। আমাদের ওখানে প্রায়ই লোকগান হতো। গানগুলো আমাকে খুব টানত। তখন থেকেই লোকগানের প্রতি ভালোবাসাটা জন্মায়। তা ছাড়া আমার কণ্ঠে ফোক গানটা ভালো যায়। ফোকে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
এ পর্যন্ত আসার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে সবটুকু কৃতিত্ব যাকে দেব তিনি আমার ওস্তাদ গোলাম রব্বানি রতন। আমি এখনও গানের ব্যাপারে পরামর্শ তার কাছ থেকে নিই। ওনাকে বাবা বলে ডাকি। আমার শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে তার অবদানের কেনো তুলনা নেই। কারণ, আমার পরিবার থেকে যখন গান করতে বাধা দেওয়া হয় তখন গোলাম রব্বানি স্যার বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আমি ওর সব দায়িত্ব নিলাম। ও আমার মেয়ে।’ এই মানুষটা না থাকলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না।

লালনের গানের সঙ্গে ফিউশন করা হয়েছে। অনেক গুণী শিল্পী এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না। আপনার মনে হয়নি যে এতে লালনের গানের আবেদন ক্ষুণ্ন হয়েছে?
বিষয়টা হয়েছে কী জানেন—ওনারা অনেক গুণী মানুষ। আমি তো ছোট মানুষ। আমার এখানে বিচার করার কোনো জায়গা নেই। তারপরও আমি বলব, আমার মনে হয় না খারাপ কিছু হয়েছে। কেননা, সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায়। এটাকেও সেই বদল বলে ধরে নিতে পারেন। আরেকটা জিনিস হলো, নতুন প্রজন্ম সবসময়ই নতুন কিছু গ্রহণ করে। যারা এমনটা বলেছেন তারা তো অনেক বড় মাপের লোক। তাদের হয়ত ভালো লাগেনি। আবার অনেকেরই ভালো লেগেছে। আমার ভার্সিটির টিচাররা খুব পছন্দ করেছেন। সবাই খুশি হয়েছেন। ভালো বলেছেন। সংগীতের ওপর পড়াশোনা করছি। লোকসংগীতই আমার পড়ালেখার বিষয়। এখানে খারাপ কিছু হলে অনেকেই বলতেন, আমি জানাশোনা মেয়ে কেন এমনটা করলাম। সেরকমও কেউ বলেননি। আর আমার কাছে মনে হয়নি মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। কারণ, আমরা তো কাঠামোটা ঠিক রেখেই কাজটা করেছি।
গান নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আমি মূলত ভালো মানের শিল্পী হতে চাই। দেখা যায়, অনেকে হুটহাট না জেনে গড়পড়তা কাজ করতে থাকেন। আমার তেমন ইচ্ছা নেই। আমি চাই আমার দুই একটা গান হলেও যেন বেঁচে থাকে। আমার মৃত্যুর পরও যেন গানগুলো মানুষের মনে নাড়া দেয়। তড়িঘড়ি করে অনেকগুলো গান করে পরিচিতি পেয়ে গেলাম আবার দুদিন পরেই নেমে গেলাম—এমন ইচ্ছা আমার নেই। পাশাপশি জীবিকার তাগিদে তো কিছু করতেই হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চাই, পেশাটা সংগীত সম্পর্কিত হোক। মানে আমি আসলে সংগীত বিষয়ক জব চাই। আর লোকসংগীতের ওপর গবেষণাও করছি আমি। ইতোমধ্যে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। তার মানে আমি গবেষক হতে চাই, এমন না। সেটা করেছি কৌতূহল থেকে। গানের ওপর পিএইচডি করার ইচ্ছা। সেই লক্ষ্যে এগোচ্ছি।
আরআর/আরএসও

